আবরার মরেছে, আমি বেঁচে আছি—তাই পত্রিকার শিরোনাম হইনি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি চালু হওয়া নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এই আলোচনা-সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
তেমনি একজন সোলাইমান খান। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা বুয়েটের সাবেক এই শিক্ষার্থীও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এ নিয়ে বিস্তর লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এই লেখার শিরোনাম দিয়েছেন ‘শহীদ আবরার মরেছে, আমি বেঁচে আছি—তাই পত্রিকার শিরোনাম হইনি’। নিচে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য সোলাইমান খানের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘২০১৬ সালের মে মাসের ২ তারিখ, সেদিন দিনগত রাতে আমার ওপর নেমে এসেছিল নারকীয় মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের স্টিম রোলার। শহিদ আবরার যে হলে ছিল, আমিও ছিলাম সেই শেরেবাংলা হলের বাসিন্দা। সেই রাতে কী হয়েছিল আমার সঙ্গে, কারা করেছিল সেই পৈশাচিক নির্যাতন, তা অন্য কোনো পোস্টে নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত লিখব অন্য একদিন।
রাত প্রায় ১১টা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত সামান্য বিরতি দিয়ে দিয়ে আমিসহ সেদিন মোট ছয়জনকে যেভাবে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়, কী অপরাধ ছিল আমাদের! বাকিদের কথা জানি না, আমার নিজের কোনো অপরাধ আমি খুঁজে পাইনি। সেই ভয়াল নির্যাতনের শিকার হয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছে। প্রায় ২ মাস আমি চেয়ারে বসে নামাজ পড়েছি।
পরদিন তৎকালীন ডিএসডব্লিউ (DSW) স্যার ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেন। ‘মানুষ আইন কেন নিজের হাতে তুলে নিবে’ ইত্যাদি শান্তনা সূচক কথা বলতে গিয়ে তিনি প্রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
কথার শেষে তিনি উপদেশ দেন, ‘জলে বাস করে তো আর কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, তুমি বাবা তাদের সঙ্গে মানিয়ে চল’। সেদিন বুঝেছিলাম- ‘খোদার ঘোড়ায় ঘাস খেয়েছে, বিচার করবে কে?’
আমি দেশের আইন বিরুদ্ধ কোনো অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টাব্যাপী ভয়াবহ নির্যাতন করে, আমার ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমেইল, মোবাইল মেসেজ, ল্যাপটপের প্রতিটা ফাইল ফোল্ডার চেক করেও তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে না পেরে আমাকে ছেড়ে দেয়। হ্যাঁ, আমার দুটি অপরাধ তারা প্রমাণ করতে পেরেছে।
প্রথমটি, ১৫ ব্যাচের (সেই সময়ে নতুন ব্যাচের) হলে সিট না পাওয়া, উত্তরবঙ্গের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এক ছেলেকে আমার সঙ্গে কয়েক দিন থাকার সুযোগ দেওয়া।
দ্বিতীয়টি, কুরআন পাঠ প্রতিযোগিতার এক অনলাইন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করা, যার অর্গানাইজার আমি ছিলাম না। আমি ছিলাম নিছক এক প্রতিযোগী।
যারা আমাকে পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছে, তাদের কারো সঙ্গে আমার কোনো পূর্বশত্রুতা ছিল না। অনেক সিনিয়রের সঙ্গে যে কয়জন জুনিয়র আমাকে নির্যাতনে অংশ নিয়েছিল তাদের কাউকে কাউকে আমি চিনতামও না। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- দেশের আইন অনুযায়ী কোন অপরাধ আমি করেছিলাম?
যদি আমি অপরাধ করে থাকি, বুয়েট প্রশাসন আছে, দেশে আইন আছে। আমাকে আইনের হাতে তুলে না দিয়ে, তারা নিজেরা যা করল, এ অধিকার তাদের কে দিয়েছে? সেই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন কি আইনের ঠিকাদার?
এর এক বছর পর ২০১৭ সালের মে মাসের ১৯ তারিখে, আমি তখন পাশ করে বুয়েটেই কর্মরত। সেদিন আমি বুয়েটে গিয়েছিলাম অ্যালামনাইদের পক্ষ থেকে সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের সংবর্ধনার এক প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়ে। সেদিন আমাকে শারীরিক নির্যাতন না করলেও অন্যভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। সে আরেক বিশাল কাহিনী। তারপর থেকে প্রাণের বুয়েটে আমি আর পা রাখি নাই। ভবিষ্যতেও ইচ্ছা নাই। হ্যাঁ, আমি মেধা পাচার করতে আমেরিকা আসি নাই, আমি পালিয়ে বাঁচতে এসেছি।
বুয়েটের একজন সাবেক শিক্ষার্থী ও অ্যালামনাই হিসাবে, আমি বুয়েটে সব ধরনের লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। বুয়েটের বর্তমান শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি একাত্মতা ঘোষণা করছি এবং তাদের সফলতা কামনা করছি।’