ছাত্রলীগের সংঘর্ষ: তিনতলা থেকে পড়ে হাত-পা ও কোমর ভেঙে পঙ্গুতে সোহান
রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ৬৪৩ নাম্বার বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান সোহান। তার এক হাত ও দুই পায়ে ব্যান্ডেজ করা। সেইসঙ্গে কোমরে বেল্ড পরানো।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শাখা ছাত্রলীগের দুপক্ষে সংঘর্ষ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জননেতা আব্দুল মান্নান হলের তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে ভেঙে গেছে তার এক হাত ও দুই পা। এছাড়া ছিঁড়ে গেছে কোমরের স্পাইনাল কর্ডও। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত চার জায়গায় অপারেশন করতে হবে।
আহত সোহানের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছে। যথাসম্ভব প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। -অধ্যাপক ড. মীর মো. মোজাম্মেল হক, প্রক্টর
তার পাশে বসে সন্তানের দিকে বিলাপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তার বৃদ্ধ বাবা-মা। সন্তান যে সময় বাবা-মায়ের সেবা করবেন, সেই সময় বাবা নিজে গুরুতর অসুস্থ হয়েও ছেলের এই অবস্থা শুনে ছুটে এসেছেন সুদূর গাইবান্ধার পলাশবাড়ি থানার হরিনাথপুর থেকে। বিলাপ করে বলছিলেন আমার মেধাবী সন্তানের এমন অবস্থা মেনে নেয়ার মতো না।
গত মঙ্গলবার রাতভর ক্যাম্পাসে চলা শাখা ছাত্রলীগের সংঘর্ষের পর এখন প্রশ্ন উঠছে, কীভাবে সোহানের এমন করুন অবস্থা হয়েছে? এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে সোহানের সঙ্গে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার সাথে আলাপে সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কে বিস্তর তথ্য উঠে এসেছে।
সোহান মাভাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীরের অনুসারী বলে ক্যাম্পাসে পরিচিতি। সোহান জানান, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে তারা কয়েকজন মান্নান হলের তিনতলার ছাদে বসে ছিলেন। এমন সময় তিনতলায় হাঁটছিল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক শীলের অনুসারী সাফি, রকি, ইদ্রিস ও রুবেল। এরপরই হঠাৎ সভাপতির রুমের দিক থেকে প্রায় ৩০ জন মুখোশধারী দেশীয় অস্ত্রসহ তিনতলার ছাদের দিকে ছুটে আসেন।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোহান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি যে পাশে ছিলাম সে পাশে তিনজন মুখোশধারী আসে। ৩০ জনের মধ্যে বাকী মুখোশধারীরা যায় অন্যদিকে। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা ছিল। এ সময় আইসিটি বিভাগের জয় ধরের মাথায় কোপ দেয় তারা। শুনেছি তার মাথায় ছয়টি সেলাই পড়েছে।
তিনি বলেন, আমার দিকে আসা তিনজনের হাতে চাপাতি ও ছুরি জাতীয় ধারালো দেশীয় অস্ত্র ছিল। তারা আমার মুখের ও গলার সামনে সেগুলো ঘোরাতে থাকে। মুখে আর গলার দিকে ধারালো অস্ত্রগুলো নিয়ে আশায় ভেবেছি, আমাকে হয়তো মেরে ফেলবে। তাই পেছনে সরতে থাকি। তখন খেয়াল ছিল না যে ছাদের কিনারায় চলে এসেছি।
‘‘এক পর্যায়ে আমি তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে যাই। নিচে ঢালাই করা ড্রেনের ওপর পড়ার কারণে পুরো আঘাত শরীরে লাগে। যদি মাটিতে পড়তাম, হয়তো এত ক্ষতি হতো না। আমি নিজে লাফ দিয়েছি এমনটি সত্য নয়। আমি কেনো নিজে নিজে লাফ দেব? আমাকে একটা আঘাত লাগলে আমি তো মরেই যাবো, এই ভেবেই আমি পিছিয়েছি’’।
তার নিচে পড়ার পর পরই একটা বিকট শব্দ হয়। আর তিনি চিৎকার করতে থাকেন ‘আমাকে মেরে ফেললো, আমাকে মেরে ফেললো’। পরে তার বন্ধুরা এসে তাকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে টাঙ্গাইলের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) ভর্তি করানো হয়।
মুখোশধারীদের চেনা যাচ্ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তাদের পোশাক আর আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ক্যাম্পাসের নয়। অর্থাৎ তাদের হয়তো ভাড়া করে এ হামলা চালানো হয়েছে। তারা তো আমাকে মেরেও ফেলতে পারতো, কারণ ক্যাম্পাসের যারা রাজনীতি করে তারা তো একটু হলেও ভয় করবে।
সভাপতির গ্রুপই এ ঘটনার সাথে পুরোপুরি সম্পৃক্ত বলে দাবি করেন সোহান। তিনি বলেন, ঘটনার সূত্রপাত যে বিষয়েই হোক না কেন তার সমাধান কখনও এভাবে হতে পারে না। যে কোনো ঘটনার জন্য জবাবদিহিতার জায়গা রয়েছে। কিন্তু এভাবে হত্যার উদ্দেশে হামলা মেনে নেওয়ার মতো না। তারা যদি মারতই, তবে লাঠিসোঁটা দিয়েও মারতে পারতো। প্রশাসনকে বলবো, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে।
এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেনসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তারা গতকাল বুধবার বিকালে তাকে হাসপাতালে দেখতে যান। এ সময় তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। একইসঙ্গে তার যাবতীয় দায়দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে বলেও জানান।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
প্রত্যক্ষদর্শী ও শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক শীলের গ্রুপের বেশ কয়েকজন নতুন কর্মীকে নিজেদের মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেয় সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীরের অনুসারীরা। এ বিষয়ে ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা এমন চাপ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্যে বলেন। এতে ক্ষীপ্ত হয়ে ওই সময় সভাপতি গ্রুপের অনুসারী রুবেলকে মারধর করেন সম্পাদক গ্রুপের অনুসারীরা।
এর জের ধরে রাতেই মুখোশধারী প্রায় ৩০ জন হামলা করে তিনতলার ছাদে বসে থাকা সম্পাদকের অনুসারীদের ওপর। এ সময় সোহান ও জয় ধর ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন আহত হন। এর প্রেক্ষিতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ওই রাতেই সভাপতির অনুসারীদের ওপর হামলা হয়। এই হামলায় সভাপতির পক্ষের বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
এর মধ্যে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের রকির মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে টাঙ্গাইলে এবং পরে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এছাড়া ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগের ফারুকের মাথায় ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের জয় দাসের পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগায় বেশ কয়েকটি সেলাই পড়েছে বলে জানা যায়। ওই দিন রাতভর সংঘর্ষে দুপক্ষের অন্তত ১০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী আহত হন।
এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক শীল ও সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীর উভয়ই প্রশাসনের প্রতি হামলার সাথে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
এদিকে, ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিকে তদন্ত রিপোর্ট প্রেরণে ১৪ দিনের সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার রাতে হল পরিদর্শনে গিয়ে এমনটি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন।
এক পর্যায়ে আমি তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে যাই। নিচে ঢালাই করা ড্রেনের ওপর পড়ার কারণে পুরো আঘাত শরীরে লাগে। যদি মাটিতে পড়তাম, হয়তো এত ক্ষতি হতো না। আমি নিজে লাফ দিয়েছি এমনটি সত্য নয়। -আহত সোহান
শাখা ছাত্রলীগের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মীর মো. মোজাম্মেল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আহত সোহানের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মিতই খোঁজখবর রাখছে। যথাসম্ভব প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি আগামী ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে বহিরাগত প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।