নিজেকে বাংলা সাহিত্যের গাণিতিক সনেটের প্রবক্তা দাবি মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীর
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী মনোরঞ্জন রায়। বাংলা সাহিত্যে প্রথম গাণিতিক সনেট রচনা করেছেন তিনি। সম্প্রতি তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “দুর্ভিক্ষের কাকদল” প্রকাশিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি গাণিতিক সনেটে লিখেছেন তিনি, যা বাংলা সাহিত্যে এর আগে কখনও ব্যবহৃত হয়নি।
মনোরঞ্জন রায়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দিনাজপুর জেলার সাহাপুর গ্রামে। পিতা নরেশ চন্দ্র রায় ও মাতা ভারতী রাণী রায়। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি ২০১২ সালে সাহাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সৈয়দপুর সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। ছোটবেলায থেকেই কবিতার প্রতি ছিল তার প্রচুর আসক্তি। প্রচুর আসক্তি থেকেই পড়তেন কবিতা, শিখতেন ছন্দ বা মাত্রার ব্যবহার এবং চেষ্টা করতেন লেখার।
তার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন হতে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মধ্যে দিয়ে। সাহিত্যোর প্রতি প্রবল আকর্ষণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যমনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়ে তোলেন “মাভাবিপ্রবি সাহিত্য সংসদ”। দিনটি ছিল ৬ এপ্রিল, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ (২৩শে চৈত্র, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ)।
এরপর করোনা মহামারিতে পুরো সময় সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পাতার প্রতিচ্ছবি” প্রকাশিত হয়। তার এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের মনকাড়ে। এ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২২ সালে “শব্দচড়ুই’’ ও ‘‘দিগন্তদুপুর,” ২০২৩ সালে “সার্বিক নদীকথা” এবং ২০২৪ সালে “দুর্ভিক্ষের কাকদল” রচনা করেন তিনি।
ক্যাম্পাসের অনেকেই তাকে মাইকেল দাদা বা সনেট দাদা বলে ডাকেন। যারা সনেট লিখে থাকেন, ইংরেজিতে তাদের সনেটার বলা হয়ে থাকে। সনেটারদের মধ্যে যাঁকে সেরা বলা হয়, তিনি হলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। তাঁর লেখা সনেটগুলোকে শেক্সপিয়ারীয় সনেট বলা হয়। বাংলা সাহিত্যের সনেট এর নাম আসলে যার কথা প্রথমেই মুখে আসে তিনি হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার লিখিত মোট ১০২টি সনেটের ভেতর অধিকাংশই দেশ প্রেমে ভাস্বর। মধুসূদন মনে করেছিলেন ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে শেক্সপিয়র, মিল্টন হবেন।
মনোরঞ্জন রায়ের ৪টি কাব্যগ্রন্থে সনেটের সংখ্যা ১৬০ এর অধিক। কাব্য রচনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন নতুন অলঙ্কার বা কৌশল। সেগুলো হলো- প্যালিনড্রোম কবিতা, অ্যানাগ্রাম সনেট, প্রতিসম সনেট, ট্রান্সপোজ সনেট, দ্বিরুক্ত সনেট, টটোমার সনেট, মেটামার সনেট, দর্পণ সনেট, অনুবন্ধী সনেট, টটোগ্রাম সনেট, অনুপ্রাস সনেট, জাতক সনেট, প্যানগ্রাম সনেট, পঞ্চাদশী সনেট, অন্ত্যাক্ষরি সনেট, কৌণিক সনেট এবং ক্রমিক সনেট।
এগুলো তার উদ্ভাবন বলে জানান তিনি, যা বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো রচিত হয়নি। তবে প্যালিনড্রোম আর অ্যানাগ্রাম দুটি ইংলিশ সাহিত্যেও আছে।
কবি মনোরঞ্জন রায় বলেন, ছোটবেলায় যখন পাঠ্য বইয়ে কবিতা পড়তাম তখন সুপ্ত ইচ্ছে জাগে কবিতা লেখার বা বই প্রকাশ করার। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সেটি সহজ হয়ে যায়। আর মাভাবিপ্রবি সাহিত্য সংসদের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা, এখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। ধারাবাহিকভাবে এ পর্যন্ত ৪টি কাব্যগ্রন্থ বের করেছি। আমি কোনো বিক্রেতা নয় বই বিক্রি হওয়া না হওয়া নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।
মনোরঞ্জনের নতুন উদ্ভাবন জায়গা করে নিয়েছে উইকিপিডিয়াতেও। তার চাওয়া, তার বই যদি দুটিও বিক্রি হয় তারপরও যেন সত্যিকারের পাঠকের কাছে যায় বলে জানান এই কবি। তার ইচ্ছা, নতুন কিছু উদ্ভাবন করে বাংলা কাব্যধারাকে সমৃদ্ধ করা, যা তার মারা যাওয়ার পরও বাংলা সাহিত্যে স্মৃতি হয়ে থাকবে।
কবি মনোরঞ্জন রায়কে নিয়ে মাভাবিপ্রবি সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, কবি মনোরঞ্জন রায় মাভাবিপ্রবি সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতি , দেখতে সহজ সরল মনে হলেও ওনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে উনি কত জ্ঞানী, কত গুনি এবং কত সমৃদ্ধ একটা মানুষ। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছেন এবং সেই সুবাদেই আবিষ্কার করছেন কিছু গাণিতিক সনেট কবিতা। যেমন: টটোগ্রাম, অনুপ্রাস। এটি তার হাত ধরেই প্রথম সূচনা। বিশ্বকোষ বা উইকিপিডিয়াতে যেভাবে তার নাম ঠাঁই পেয়েছে ঠিক সেভাবেই একদিন ঠাঁই করে নিবে পাঠকদের মনেও।
মনোরঞ্জনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পাতার প্রতিচ্ছবি” প্যালিনড্রোম কবিতা, অ্যানাগ্রাম সনেট ও প্রতিসম সনেটে লেখা। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “শব্দচড়ুই ও দিগন্তদুপুর” ট্রান্সপোজ সনেট, দ্বিরুক্ত সনেট, টটোমার সনেট, মেটামার সনেট, দর্পণ সনেট, অনুবন্ধী সনেট, টটোগ্রাম সনেট, অনুপ্রাস সনেট ও জাতক সনেটে লেখা। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “সার্বিক নদীকথা” প্যানগ্রাম সনেট, পঞ্চাদশী সনেটে লেখা এবং চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ “দুর্ভিক্ষের কাকদল” অন্ত্যাক্ষরি সনেট, কৌণিক সনেট এবং ক্রমিক সনেটে লিখা।
প্রসঙ্গ, চতুর্দশপদী (সনেট) হল এক ধরনের কবিতা যার প্রথম উদ্ভব হয় মধ্যযুগে ইতালিতে। এই কবিতাগুলো ১৪টি চরণে সংগঠিত। এর প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষটক বলে।