১২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৫৭

মাভাবিপ্রবির ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

১২ অক্টোবর মাভাবিপ্রবির ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কাটার মুহূর্ত  © টিডিসি ফটো

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পূর্ণ করে ২৫ বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৯৯ সালের এই দিনে (১২ অক্টোবর) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের ১৩তম পাবলিক এবং ৩য় বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে মাভাবিপ্রবি।

দিনটি স্মরণে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কর্মসূচির মধ্যে এদিন সকাল ১০ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. ফরহাদ হোসেন, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এ আর এম সোলাইমান এবং কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. সিরাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা ও বিশ্ববিদ্যালয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সদস্য, ডিন, রেজিস্ট্রারকে নিয়ে পায়রা, বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুর‌্যাল ও মাওলানা ভাসানীর মাজারে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পরে ভাইস-চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা ক্যাম্পাসের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। শোভাযাত্রা শেষে ১২ তলা একাডেমিক ভবনের সামনে কেক কাটা হয়। এছাড়া বাদ যোহর কেন্দ্রীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

মাভাবিপ্রবির এই দুই যুগ পূর্তিতে এদিন সকাল ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে কেক কেটে দিনটি উদযাপন করেছে মাভাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। এ সময় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. এ, এস, এম সাইফুল্লাহ, সহ-সভাপতি প্রফেসর ড আহসান হাবিব এবং সাধারন সম্পাদক প্রফেসর ড. মাসুদার রহমানসহ অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

মাভাবিপ্রবির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর স্মৃতি বিজড়িত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুই যুগ হলেও এর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ‍সুদূরপ্রসারী ইতিহাস। মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপনে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন। তিনিই ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্তোষে অনুষ্ঠিত (বর্তমান মাভাবিপ্রবি) কাগমারী সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেন নি।

অবশেষে ১৯৭০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মাওলানা ভাসানী "আমার পরিকল্পনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়" শিরোনামে লিখিত নিবন্ধের মাধ্যমে তাঁর প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত প্রস্তাব করেন। তারই ধারাবাহিকতায় এর অভ্যন্তরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। কিন্তু তিনি জীবদ্দশায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে তিনিই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় কাজ শুরু করে যান।

এরপর ১৯৮২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ভাসানীর শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনায় একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালের ১৫ ডিসেম্বের ১২ সদস্যবিশিষ্ঠ একটি কমিটিও গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে ২২ মে সুদূরপ্রসারী সুপারিশ রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করেন।

আরও পড়ুন: ১৫ বছরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অর্জন ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রপতি ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাবিদ ডক্টর মীর ফকরুজ্জামানকে চেয়ারম্যান ও সৈয়দ ইরফানুল বারীকে সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যবিশিষ্ঠ সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (সইবি) ট্রাস্টি বোর্ড গঠনও করে দেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন জটিলতায় এর কার্যক্রম আর সামনে এগোয় নি।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের প্ররিকল্পনা গ্রহণ করে। এর পরিপ্রক্ষিতে সন্তোষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (সইবি) ট্রাস্টি বোর্ড সরকারের নিকট সন্তোষেই একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব পেশ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক স্বরাষ্ট্র এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে টাঙ্গাইলের গণ্যমান্য বাক্তিদের প্রচেষ্টায় অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সন্তোষে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ পেশ করা হয়। অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১২ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 

২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম ‍শুরু হয়। এরপর ২০০২ সালের ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক অধ্যাপক ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদ খান। 

২০০২ সালে অধ্যাপক ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদ খানকে উপাচার্য নিয়োগ পর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ দুটি বিভাগে ৭৫ জন শিক্ষার্থী এবং ৫ জন শিক্ষক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।

এরপর ২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর লাইফ সায়েন্স অনুষদের অধীনে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স নামে দুটি নতুন বিভাগ খোলা হয়। যার মধ্যে দিয়ে দেশে প্রথম অপরাধ বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশে একাডেমিক ভাবে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সূচনা হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৭টি অনুষদের অধীনে ২০টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন। তিনি ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এক দশক পরও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় থেমে ছিলো এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তবে গত ৫-৭ বছরে এর আমুল পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে লাল-সাদা ইটের দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল ভবন। এর মধ্যে অন্যতম ৩টি একাডেমিক ভবন, ২টি প্রশাসনিক ভবন, একটি মাল্টিপারপাস ভবন, ৪টি ছাত্র হল, ৩ টি ছাত্রী হল, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মেডিকেল সেন্টার, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সুবিধার্থে ৫ তলা বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধার জন্য ৩ টি কোয়ার্টার।

এর পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চলাচলের জন্য নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা, ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে প্রত্যয়’৭১ ও বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, জিমনেসিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ইত্যাদি। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই শায়িত আছেন এর স্বপ্নদ্রষ্টা মওলানা ভাসানী এবং ক্যাম্পাসে জুড়ে ছড়িয়ে আছে তার স্মৃতি। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক দরবার হল ও কাগমারী সম্মেলনের স্মৃতি স্তম্ভ এবং মাওলানা ভাসানীর হাতে গড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

২০২৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সিরাজগঞ্জ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ মাভাবিপ্রবি বহিঃক্যাম্পাস (দ্বিতীয় ক্যাম্পাস) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে মাভাবিপ্রবির ভেটেরিনারি চিকিৎসা এবং পশুবিজ্ঞান অনুষদ হিসেবে নামান্তর করা হয়েছে।

সিরাজগঞ্জে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসটি ১০ একর জায়গা নিয়ে গঠিত। এই জায়গায় একাডেমিক ভবন, পশুচিকিৎসা হাসপাতাল, পশুর শেড, অডিটোরিয়াম, ছাত্র-ছাত্রী হল ইত্যাদির মতো বিভিন্ন অবকাঠামো রয়েছে।

ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত ৮০ দশমিক ৬৯ একরের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ২৫০ এর অধিক শিক্ষক এবং প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।