১০ জুলাই ২০২৩, ১৫:৪২

অধিকাংশ চাকরিতে আবেদন বঞ্চিত নোবিপ্রবির বিএমএস বিভাগের গ্র্যাজুয়েটরা

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

২০১৬-১৭ সেশন থেকে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) বাংলাদেশে ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ (বিএমএস) বিভাগ চালু হয়। বর্তমানে দুটি ব্যাচ স্নাতক শেষ করে বের হলেও বিভাগটির নির্দিষ্ট বিষয় কোড না থাকায় অধিকাংশ সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না এসব গ্র্যাজুয়েটরা। ফলে ডিগ্রি পরিবর্তনের দাবিতে টানা ৪৯ দিন ক্লাস-পরীক্ষার বাইরে রয়েছে বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই বিভাগকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব নতুন বিষয়ে এখনও আমাদের দেশে আশানুরূপ জব মার্কেট গড়ে উঠেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিভাগ চালু করার সময় শিক্ষারর্থীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করা উচিত।

জানা যায়, গত ২১ মে বিভাগ পরিবর্তনের দাবিতে উপাচার্য বরাবর একটি আবেদন জমা দিয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় নোবিপ্রবি বিএমএস বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এই দাবির সাথে একমত পোষণ করে একাধিকবার বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে দেখা করেছে বিভাগের সকল ব্যাচের শিক্ষার্থী। 

বিভাগটির নাম অপরিচিত বিধায় এবং নির্দিষ্ট বিষয় কোড না থাকায় বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এই বিভাগের সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীদের। এতে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীসহ বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের লিখিত আবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিএমএস বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই বিভাগের ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীরা স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছে। নাম অপরিচিত বিধায় এবং নির্দিষ্ট বিষয় কোড না থাকায় বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এই বিভাগের সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থীদের। এতে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীসহ বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। 

স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের বিভিন্ন কোর্সের সঙ্গে মিল থাকায় বিভাগের নাম অথবা ডিগ্রিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাস এর মধ্যে অধিক প্রাসঙ্গিক বিভাগে পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছে বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্য বরাবর দেয়া আবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিভাগের কোর্সসমূহ রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাস নামে কোন বিভাগ না থাকায় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের নাম পরিবর্তন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা ইতিহাস নামে স্থানান্তরিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিষয়টি যৌক্তিক কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল থেকে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ড. মুহাম্মদ আলমগীর সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। 

সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের তৎকালীন ডিন ও বিএমএস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দিব্যদ্যুতি সরকারকে আহবায়ক এবং শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) জিএম রাকিবুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে গঠন করা কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম, এপ্লায়েড কেমিস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল আলম, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. এমডি মাসুদ রহমান এবং শিক্ষা শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার নার্গিস আক্তার হেলালী।

টেকনিক্যাল কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে আহবায়ক অধ্যাপক ড. দিব্যদ্যুতি সরকার বলেন, শিক্ষার্থীদের উন্নত ভবিষৎ গড়ার লক্ষ্যে ভিন্ন কয়েকটি উপায়ে আমরা এই সমস্যার সমাধান করতে পারি। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল থেকে একটি কমিটি গঠন করে আমাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা কমিটির সদস্যরা কয়েক দফায় বসে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসসমূহ পর্যালোচনা করেছি। এসব বিষয় আলোচনা করে আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। 

একটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রাধান্য পাওয়ার কথা। ইতিহাস বা এই জাতীয় সাবজেক্ট এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সাথে কতটা যৌক্তিক? বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল যারা রয়েছেন তাদের সব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত- ইউজিসি সদস্য ড. মো: আবু তাহের

কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে  ড. দিব্যদ্যুতি সরকার জানিয়েছেন, বিভাগের বর্তমান কারিকুলাম পর্যালোচনা করে ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়া অথবা বিভাগের নাম মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায়, এটি বিলুপ্ত না করে এই নামে একটি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট গঠন করে বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নামক দুইটি বিভাগ সৃজন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ইউজিসিতে প্রতিবেদন পাঠানোর বিষয়ে নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ড. মুহাম্মদ আলমগীর সরকার বলেন, আমাদের প্রতিবেদন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে পাঠিয়ে দিয়েছি। কমিশনের সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। 

এই বিষয়ে উপাচার্য (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাকী বলেন, এই বিষয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি কিছু সুপারিশ উল্লেখ করে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ইউজিসি বিষয়টি আলোচনা পর্যালোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের ভালো চাই। তাদেরকে সুন্দর একটি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা থাকবে আমাদের।  

নতুন বিভাগ খুলতে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য ড. মো: আবু তাহের বলেন, একটা বিভাগ চালু করার সময় এটা চিন্তা করা উচিত, এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কি? শিক্ষার্থীদের তো এখানে দোষ নেই। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বিভাগ খোলায় শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়বে এটাও কাম্য নয়। তবে যদি একটা বিভাগের পরিবর্তে দুটো বিভাগ একটা ইনস্টিটিউটের প্রস্তাবনা দেয়া হয়, একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সেটাও আমার ভালো সমাধান মনে হয় না। তারা বরং বর্তমান পরিস্থিতি চিন্তা করে এই বিভাগকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পরিবর্তন করতে পারে।

এসম তিনি আরও বলেন, এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ আমি পাইনি। তবে একটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি  বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রাধান্য পাওয়ার কথা। ইতিহাস বা এই জাতীয় সাবজেক্ট এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সাথে কতটা যৌক্তিক? বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল যারা রয়েছেন তাদের সব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

ইউজিসির আরেক সদস্য ড. মো: আলমগীর বলেন, ‘আমি  এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ পাইনি তাই বিস্তারিত মন্তব্য করতে পারছি না। তবে আমাদের দেশে এখনও এই ধরনের বিশেষায়িত সাবজেক্ট চালুর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয় নি। কারণ এখনও আমাদের এসব সাবজেক্টের আশানুরূপ জব মার্কেট গড়ে উঠেনি। আমাদের অধিকাংশেরই এখনও লক্ষ্য সরকারি চাকরি।

এ বিষয়ে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, আমি এখনো এ ধরনের কোনও চিঠি পাইনি। একটা বিভাগকে ভেঙে যদি তিনটা বিভাগের সুপারিশ করা হয়ে থাকে সেটা অবাস্তব একটা বিষয় হবে। শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ওই বিভাগের নাম বা ডিগ্রিকে ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান করা যেতেই পারে কিন্তু একটা বিভাগকে ভেঙে তিনটা বিভাগেরতো যৌক্তিকতা নেই। আর এটা একটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কি ইতিহাস বা এ জাতীয় বিভাগগুলো যায়?

তিনি আরও বলেন, বিবিএ ফ্যাকাল্টির অনেক বিভাগে গণিত, পরিসংখ্যানের শিক্ষক থাকে। অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয় পড়ানোর জন্য রসায়ন, পদার্থ এমনকি সোশিওলজির শিক্ষক থাকেন। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়েরতো শিক্ষকদের ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় নতুন সাবজেক্ট খোলার প্রয়োজন হয়নি।