ছাত্রীকে কক্ষে আটকে হেনস্তার গুরুতর অভিযোগ প্রভোস্টদের বিরুদ্ধে

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হল প্রভোস্টের কক্ষে আটকে রেখে হেনস্তার অভিযোগে ওঠেছে ওই হলেরই একাধিক প্রভোস্টের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় প্রভোস্টের সঙ্গে কয়েকজন সহকারী প্রভোস্টও জড়িতে রয়েছেন। হল কক্ষে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে আটকে রেখে জোরপূর্বক তাদের শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্যের স্বীকারোক্তি আদায়ে হেনস্তার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।

এমন ঘটনা ‘স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করছে’ বলে উল্লেখ করে গত রোববার (২৩ অক্টোবর) ‘মানসিক এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থা’র আবেদন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী সে ছাত্রী।

লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ছাত্রী উল্লেখ করেন, গত ২০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) বিকাল ৩টায় টিউশনির উদ্দেশ্যে বের হলে তাকে প্রভোস্টের রুমে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রভোস্ট জোবেদা কনক খান, সহকারী প্রভোস্ট ফাহমিদা আক্তারসহ আরও দুইজন সহকারী প্রভোস্ট উপস্থিত ছিলেন। তখন প্রভোস্ট জোবেদা কনক খান বাইরে যেকোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও তাকে ওই মুহূর্তে তাদেরকে সময় দিতে বলেন। তাকে মুঠোফোন বন্ধ করতে বলেন এবং তার ব্যবহার্য ব্যাগসহ মুঠোফোনটি বন্ধ করে তাদের জিম্মায় রেখে দেন।

প্রভোস্ট বডির সদস্যরা তখন ভুক্তভোগী ছাত্রীর বিরুদ্ধে তার সাবেক রুমমেট, ওশেনোগ্রাফি বিভাগের ছাত্রী (জেরি আক্তার) কোনো এক স্যারের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে বলে জানান। তবে রুমমেটের (জেরি আক্তার) এমন অভিযোগের ব্যাপারে অবগত নন এবং এর সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক বরাবর জমা দেয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী।

লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, বিষয়টিতে আমার সম্পৃক্ততা নেই জানিয়ে আমার বক্তব্য প্রদান করেছিলাম; যা তাদের মধ্য থেকে একজন ম্যাম রেকর্ড করে নেন। আমার সঙ্গে কথা বলার কিছু সময়ের মাথায় সানজিদা সুলতানা জেরিন ম্যামসহ আরও একজন ম্যাম কক্ষে আসেন।

লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ছাত্রী উল্লেখ করেন, তারা কথা বলার সময় নানাভাবে আমার ছাত্রত্ব বাতিল, হলের সিট বাতিল করে দেওয়াসহ নানারকম হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। যেহেতু অভিযোগটির সাথে আমার কোন ধরনের সম্পৃক্ততা ছিলো না; তাই আমি শুরু থেকেই বিষয়টির বিপক্ষে ছিলাম। তাদের নিকট আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু সেই সময়েও তারা আমাকে ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়ার ব্যাপারসহ নানা রকম ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন। যেখানে আমার সম্পৃক্ততা নেই এমন একটি বিষয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, এসব কর্মকান্ড চালানোর সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা রেকর্ডিংটি বন্ধ রাখেন এবং আমাকে প্রলোভন দেখান যেন আমি বিষয়টি স্বীকার করি। তারা আমাকে বলেন স্বীকা করে নিলে কোন ধরনের সমস্যা হবে না; নতুবা আমার হল ক্লিয়ারেন্স ও ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়া হবে। তখনো আমি আমার অবস্থানে অটল ছিলাম।

এরপর প্রায় দেড় ঘন্টার মতো কথা বলার পর জোবায়দা কনক খান ম্যাম ও মমতা খালা আমাকে সাইকোলজিস্ট ম্যামের কক্ষে নিয়ে যান এবং আমাকে সেই কক্ষের ভেতরে রেখে বাইর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেন। তার ১ ঘন্টা ২০ মিনিট পর মমতা খালা আমাকে সেই কক্ষ থেকে বের করে প্রভোস্ট ম্যামের কক্ষে নিয়ে যায়। পরে পুনরায় অভিযোগটি সত্য প্রমাণ করানোর জন্য নানাভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এসময় আমার সাবেক রুমমেইটও উপস্থিত ছিলো।

আরও পড়ুন: যবিপ্রবির ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সনদ অবৈধ, নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থা

লিখিত অভিযোগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর অপহরণের মতো একটি ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী ছাত্রী। তিনি বলেন, আমার মানসিক অবস্থা বেশ খারাপ ছিলো। আমি সাইকোলজিস্ট ম্যামের কাউন্সিলিংয়ে ছিলাম। যেটির ব্যাপারে হল কর্তৃপক্ষ অবগত রয়েছেন। এমতাবস্থায় ৩ ঘন্টার অসহনীয় মানসিক চাপ সহ্য না করতে পেরে শেষ মুহূর্তে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমি বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু তখনো আমি পূর্বের-ন্যায় আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকি এবং বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই ও এতে আমার সম্পৃক্ততা নেই বলে তাদের জানাই।

অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, তারা সম্পূর্ণ বিষয়গুলো তাদের কাছে রেকর্ড করে রেখে দেয় এবং বিভিন্নভাবে হুমকি ও ভয় দেখাতে থাকেন। সেইসঙ্গে তারা তাদের শিখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে আমাকে একটি লিখিত বয়ান দিতে বলে। আমি ‘অবগত নই এবং আমার সম্পৃক্ততা নেই’ এমন একটি বিষয়ের উপর জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা এবং নানাভাবে হেনস্তা করায় আমি অনেক বেশি মানসিক চাপ অনুভব করছি, যা আমার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যহত করেছে।

অভিযোগের বিষয়ে বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জোবেদা কনক খানের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “তার অভিযোগ আমি জানি না। এটার দায়িত্ব তো ডিএসডাব্লিউর (ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক)। ওনি এটা কাজ করবেন, দেখবেন, বুঝবেন। আমার তো এখানে কিছু বলার নাই।” এছাড়া ‘ওই ছাত্রী যে অভিযোগ করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক প্রফেসর আমিনা পারভীন বলেন, “আমি ওটা (অভিযোগপত্র) পেয়েছি। আমার দপ্তরে আমি এটা দেখার চেষ্টা করছি এবং কনফিডেন্টশিয়ালি করছি। এর বেশি আমি শেয়ার করতে পারব না।”

এদিকে প্রভোস্ট ও ভুক্তভোগী ছাত্রীসূত্রে জানা যায়, ২০ অক্টোবর জেরি আক্তার ও ভুক্তভোগী ছাত্রী দুজনকেই লিখিত দিতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ২৩ অক্টোবর হল প্রভোস্ট বরাবর একটি লিখিত দেয়ার পাশাপাশি ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক বরাবর ‘মানসিক ও সার্বিক নিরাপত্তা’ চেয়ে অভিযোগপত্র জমা দেন সে ছাত্রী।

পরবর্তীতে ভুক্তভোগী সে ছাত্রীকে ‘২০ অক্টোবর জেরি আক্তারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার স্বীকারোক্তিতে অনুমতি ব্যতিত প্রভোস্টের ফোনালাপ রেকর্ড করার চেষ্টা করেছিলেন এবং অবৈধভাবে বহিরাগত এক শিক্ষার্থীকে রুমে রেখেছেন’ বলে উল্লেখ করে তিন কার্য দিবসের ভেতরে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবিষয়ে লিখিত প্রদানের জন্য শোকজ লেটার দেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে শোকজ লেটারের লিখিত জবাব জমা দিয়েছেন সে ছাত্রী।

প্রভোস্টের কল রেকর্ডের বিষয়ে ভুক্তভোগী সে ছাত্রী বলেন, “ম্যামের (প্রভোস্ট) সাথে বন্যার পর পর একবার ফোনে কথা হয়েছিল হলের পানির একটা ইস্যু নিয়ে। ওইখানে ম্যামের সাথে এমন কোনো কনভার্সেশন ছিল না যেটা রেকর্ড করতে হবে বা ফোন রেকর্ড করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।”

জানা যায়, ভুক্তভোগী ছাত্রী, জেরি, তান্নি এবং তাজকিয়া নামের চার ছাত্রী একই রুমে থাকতেন। তাদের মধ্যে তান্নি সেই রুমের আবাসিক ছাত্রী হলেও ইন্টার্নশিপের জন্য নিয়মিত হলে থাকতেন না। ক্যাম্পাসে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলে বা দিন শেষে বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলে তান্নিকে জানিয়ে তারই বিভাগের বান্ধবী লিজা মাঝে মাঝে তার সিটে থাকতেন।

শোকজ লেটারে উল্লেখিত অবৈধভাবে বহিরাগত শিক্ষার্থীকে রুমে রাখার বিষয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী বলেন, “যাকে বহিরাগত বলা হয়েছে সে আমার রুমমেটের (তান্নি) সিটে মাঝে মাঝে থাকতো। তাকে রুমে আনা, রুমে থাকতে দেয়ার ব্যাপারে আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।

এবিষয়ে তান্নির সাথে কথা বললে তিনিও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, “তার (লিজা) যেদিন বাসায় ফিরতে লেট হয়ে যেত সেদিন সে (লিজা) আমাকে বলতো সে আমার সিটে থাকবে। আমি যেহেতু ক্যাম্পাসে ছিলাম না। তাই সে বললে আমি না করতাম না। তার (লিজা) থাকা না থাকা নিয়ে ওর (ভোক্তভুগি ছাত্রী) কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।”

খাতায় সাইনের বিষয়ে জানতে চাইলে তান্নি বলেন, “আমি তাকে (লিজা) জিজ্ঞেস করছি যে তুই আমার সাইন দিয়েছিস কি না? আমার ফ্রেন্ড বলছে- না, ও আমার সাইন দেয় নাই। ও দুই তিন ছিল। কিন্তু খাতায় নাকি আমার সাইনে ভরা। আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে এ কাজটা জুনিয়ররা করেছে।”

লিজা বলেন, “ওর (ভুক্তভোগী) সাথে আমার খুবই ফরমাল সম্পর্ক ছিল। রুমে থাকা না থাকা নিয়ে ওর সাথে আমার কখনো কথা হয় নাই। আমি দুইয়েকদিন সেখানে ছিলাম। তান্নির সাথে কথা বলে সেখানে ছিলাম। তবে যে কয়দিন ছিলাম আমি কোনো সাইন দেইনি।’’

The Daily Campus এর খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন