২৯ এপ্রিল ২০২০, ২৩:৫৮

১৮ বছর সংগ্রাম শেষে এমপিও, বেতন কোন মাসে?

সংগ্রামটা আজকের নয়; দীর্ঘ এক দশক, এক যুগ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে চলে আসছিল। পরিবার-সমাজে পরিচয় শিক্ষক হলেও বিনা পয়সায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে হচ্ছিল বছরের পর বছর। হয়তো বুকে জমে থাকা এ কষ্ট থেকেই দু’বছর আগে আমরণ অনশনে নামা স্কুল শিক্ষিকা শাহিন সুলতানা বলেছিলেন, ‘১৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে হাজার হাজার ছাত্রকে পড়িয়েছি। কেউ আজ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। সরকার আজ তাদের লাখ লাখ টাকা বেতন দিচ্ছে। অথচ আমরা যারা তাদের গড়েছি, তারাই আজ রাস্তায়। এ কষ্ট দেখার কি কেউ নেই’? চিৎকার করে অসহায় শাহিন সেদিন প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমরা কী করবো, কার কাছে যাবো? বিনা বেতনে আর কত দিন?’ 

শাহিন সুলতানাদের সেই কষ্টের ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে ২০২০-এ। ১৮ বছর কষ্টের ফসল হিসেবে বুধবার ঘোষিত এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তার প্রতিষ্ঠান ঠাঁই পেয়েছে কিনা জানা না গেলেও  অনেকের ভাগ্য এদিন খুলেছে। সংগ্রামটা দীর্ঘ হলেও সরকার তাদের নিরাশ করেনি। শেষ হয়েছে তাদের শত শত মানববন্ধন, ধর্মঘট-অনশনের মত কর্মসূচিও। প্রতিষ্ঠানের তকমাও এখন নন-এমপিও থেকে এমপিও। বছরের পর বছর বেতন ছাড়া খেটে আসা কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের পরিবারের মুখেও আজ এক চিলতে হাসি। কারণ, আন্দোলন-ধর্মঘটের কষ্টটা যে তাদের একেবারেই শেষ হয়েছে। অপেক্ষা এখন শুধুই নিয়মতান্ত্রিকতা। এরপরই কাঙ্ক্ষিত বেতনটা হাতে চলে আসবে।

তথ্যমতে, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বশেষ এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল ২০০৯ সালের ১৬ জুন। সেবার সারাদেশের এক হাজার ৬০৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) এমপিওভুক্ত করা হয়। প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী সে সময় সরকারি বেতনের আওতায় এসেছিলেন।

কিন্তু কবে বেতন পাবেন সদ্য চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা? জানতে চাইলে মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, তালিকাভুক্ত হওয়া প্রতিষ্ঠানকে এখন যে কাজটি করতে হবে, তা হলো- বিধি অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির আবেদন করবেন এবং আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করবেন। এরপরই তারা বেতন-ভাতা পাবেন। আদেশ এখন জারি হলেও পূর্বঘোষণা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা গত বছরের ১ জুলাই থেকে বেতন-ভাতা পাবেন।

কবে বেতন পাবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘চলতি অর্থবছরেই নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন ভাতা পাবেন। আমরা সেই টার্গেট নিয়েই কাজ করছি। তিনি বলেন, মূল কাজটা শেষ হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিক কিছু কাজ বাকি রয়েছে। সেটা শেষ হলেই শিক্ষকরা বেতন ভাতা পাবেন।

দীর্ঘদিন পর নানাবিষয় বিবেচনা করে এমপিও’র ঘোষণা এলেও বাদ পড়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে হতাশ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও। শিক্ষক নেতাদের দাবি ছিল, দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে বিনা বেতনে চাকরি করছেন। অনেকের চাকরির বয়স শেষের পথে। সে হিসেবে সকল প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে এমপিওভুক্তি করা হোক। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় মাত্র দেড় হাজার প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ সেই দাবি অপূর্ণই থেকে গেল।

বুধবার প্রকাশিত আদেশের তথ্যমতে, চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে বেতন-ভাতা পাবেন। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ২৭৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিভুক্ত করা হলেও এখন প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও কোড পাওয়ায় শিক্ষকরা সরকারি বেতনের অংশ পাবেন।

নিয়মানুযায়ী, এমপিও কোড পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের অনলাইনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে তাদের এমপিও কার্যকর করে সরকারি বেতন-ভাতা পাঠানো হবে। এক্ষেত্রে কোনো শিক্ষকের নিয়োগ, নিয়োগের বিপরীতে শিক্ষাগত অসম্পূর্ণ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তার বেতন আটকে যেতে পারে।

এর আগে জারিকৃত এক আদেশে নতুন এমপিওভুক্তদের চারটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এমপিওভুক্ত হওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অনুযায়ী ওইসব যোগ্যতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে সেই প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করা হবে বলেও আদেশে বলা হয়। এগুলো হচ্ছে—এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো-২০১৮ অনুযায়ী আরোপিত শর্ত পূরণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা নিয়োগকালীন বিধি-বিধান ও সংশ্লিষ্ট পরিপত্র মোতাবেক প্রযোজ্য হবে। নিবন্ধন প্রথা চালু হওয়ার আগে বিধিসম্মতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির সুযোগ পাবেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের অবশ্যই নিবন্ধন সনদ লাগবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বিবেচিত হয়েছে তার মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অনুযায়ী কাম্য যোগ্যতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে সেসব প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করা হবে এবং পরবর্তী সময়ে কাম্য যোগ্যতা অর্জন করলে এমপিও ফের অবমুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা হবে। যেসব তথ্যাদির আলোকে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, পরবর্তী সময়ে কোনো তথ্য ভুল বা অসত্য প্রমাণিত হলে তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রদানকৃত তথ্যের সঠিকতা সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এমপিওভুক্তির আদেশ কার্যকর করা হবে।

বাদ পড়ল ১৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: এদিকে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ঘোষিত এমপিও'র চূড়ান্ত থেকে ১৮টি স্কুল এন্ড কলেজ বাদ পড়েছে। এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯৯১টি মাধ্যমিক স্কুল, ৪৩০টি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, ৬৮টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৯২টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ এবং ৫২টি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে। মোট ১ হাজার ৬৩৩টি স্কুল-কলেজ চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে। যদিও গত ২৩ অক্টোবর প্রকাশিত প্রাথমিক তালিকায় ১ হাজার ৬৫১টি স্কুল-কলেজ স্থান পেয়েছিল।

জানা গেছে, ৯টি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল, ৪টি মাধ্যমিক স্কুল, ১টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ এবং ৪টি ডিগ্রি কলেজ চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

তথ্যমতে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এমপিও কোড বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনও এই কোর্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। কোড বরাদ্দ দিয়ে বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে আদেশে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।