২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:২৬

শিক্ষা ক্যাডারের ইতিহাসে বড় বদলি, নীতিমালা লঙ্ঘন ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ

শিক্ষা মন্ত্রণালয়  © ফাইল ফটো

শিক্ষা ক্যাডারের সবচেয়ে অন্যতম বড় বদলি হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ৫০০ কর্মকর্তাকে একযোগে বদলি ওই ঘটনার পর থেকেই শিক্ষা প্রশাসনে তীব্র অসন্তোষ ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এসব বদলিতে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়; শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব বদলি হয়েছে বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট মহলটিতে আলোচনা রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ চার থেকে নয় মাস পূর্বে বর্তমান কর্মস্থলে যোগ দিয়েছিলেন। বদলি নীতিমালার ৪.৩ এর (খ) অনুযায়ী ‘শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক/কর্মকর্তাগণ একই কর্মস্থলে ২ (দুই) বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অন্যত্র বদলির জন্য আবেদন করতে পারবেন না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই নীতিমালা উপেক্ষা করেই নির্বাচনকালীন সময়ের ঠিক শুরুতে এ ধরনের গণবদলি করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের বদলি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।

যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলির ফাইল আটকে ছিল। নানা কারণে সেই ফাইলগুলো স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার রাতে জমা হওয়া ফাইলগুলো স্বাক্ষর করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব (কলেজ-১) খোদেজা খাতুন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারদের বদলির ফাইলে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন আমাদের সচিব মহোদয়। এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। সিন্ডিকেট কারা চালায় কিংবা আর্থিক লেনদেন কারা করে সে বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত না। বদলির জন্য কারো কাছে কোনো টাকাও কখনো নেইনি।’

বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ ৪ থেকে ৯ মাস পূর্বে বর্তমান কর্মস্থলে যোগ দিয়েছিলেন। বদলি নীতিমালার ৪.৩ এর (খ) অনুযায়ী ‘শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক/কর্মকর্তাগণ একই কর্মস্থলে ২ (দুই) বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে অন্যত্র বদলির জন্য আবেদন করতে পারবেন না’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেই নীতিমালা উপেক্ষা করেই এ ধরনের গণবদলি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন সংস্থা, দপ্তর থেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন যোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা সংগ্রহ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক থেকে দুই মাস পূর্বে এ তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই কর্মকর্তারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছেন। তবে তফশিল ঘোষণার পর এ ধরনের গণবদলি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অন্তরায় হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে বদলি সিন্ডিকেট নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, ডিআইএর একাধিক কর্মকর্তার নাম সামনে এসেছে। এই সংস্থাগুলোর কয়েকজন কর্মকর্তার হাতে শিক্ষা ক্যাডারের বদলি নির্ভর করে বলে জানা গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই যুগ্মসচিব, প্রভাবশালী এক উপসচিব, মাউশির এক পরিচালক, শিক্ষা প্রকৌশলের শীর্ষ এক কর্মকর্তা, ডিআইএর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলে অনুসন্ধানে সামনে এসেছে।

শিক্ষা ভবন

গণবদলির পর এই সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে অনেকে তাদের বদলি ঠেকিয়েছেন, ফিরেছেন ঢাকায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলি আদেশের সংশোধনী দেখে। বদলি আদেশের ১০ দিন পর গতকাল রবিবার পাঁচটি ভিন্ন প্রজ্ঞাপনে বদলির আদেশে সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনীতে ঢাকার বাইরে বদলি হওয়া অনেককেই আবারও ঢাকায় পদায়ন করা হয়।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বদলি হওয়া শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা মূলত বদলি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তার সুপারিশ ছাড়া ‘ভালো’ পদায়ন হয় না। বদলির এই সিন্ডিকেটের কারণে অনেক শিক্ষা ক্যাডার চরম বিপাকে পড়েছেন। দুই বছর পর বদলি হওয়ার কথা থাকলেও সেই নিয়মও মানা হচ্ছে না। বদলির এই সিন্ডিকেট সম্পর্কে সবািই জানে। তবে কোনো এক অজানা কারণে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।’

অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার বদলি, চরম দুর্ভোগ
এদিকে হঠাৎ শিক্ষা ক্যাডারদের এই বদলিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেক কর্মকর্তা। কেউ বাসা ভাড়া নিয়ে উঠেছেন, কেউ সন্তানদের নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছেন, এর মধ্যেই আবার নতুন কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ পেয়েছেন তারা। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বরছেন, এই ধরনের অস্থির বদলি শুধু কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত জীবন নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রমকেও ব্যাহত করছে। একজন কর্মকর্তা নতুন দায়িত্ব বুঝে ওঠার আগেই আবার বদলি হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা নষ্ট হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চার মাস আগে বদলি হয়ে ঢাকায় এসেছি। সংসার গুছাতে না গুছাতেই আবার বদলি। পরিবার নিয়ে কীভাবে আবার শুরু করব তা বুঝে উঠতে পারছি না।’

নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই এ ধরনের বড় পরিসরের বদলি প্রশাসনিকভাবে কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে এই গণবদলি পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করছেন, এই বদলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্বাচনকে ঘিরে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারের কৌশলের অংশ হবে।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আববার এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।