শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিশোর অপরাধ রোধে সরকারের নতুন উদ্যোগ
রাজধানীসহ সারা দেশে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জে তুচ্ছ কারণে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এমন অপরাধ হরহামেশাই ঘটছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিশোর অপরাধ সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদকসেবন ও ইভটিজিং থেকে শুরু করে এমন সব লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কিশোররা এখন যুক্ত হচ্ছে— যা অকল্পনীয়। কিশোর বয়সের চাহিদা হলো কৌতূহলের বশে নতুন কিছু জানতে চায়, শিখতে চায়, নিজেকে সবার সামনে উপস্থাপন করতে চায়। এ স্বতঃস্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষাকে যদি মাতা-পিতা, শিক্ষক, অভিভাবক সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারেন তবে এ ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যৎ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে সফল মানুষ হয়। নতুবা সে নানাবিধ অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে যায়। বিশেষ করে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন আচরণ লক্ষ করা যায়। কিশোর অপরাধের ধরণ, কারণ এবং শিক্ষক, অভিভাবকের কি ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে সরকার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন উদ্যোগ দেশে এটিই প্রথম।
মন্ত্রণালয়টি জানিয়েছে, ‘কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধকল্পে বিদ্যালয় সমাজকর্ম ব্যবস্থা প্রবর্তন' শীর্ষক প্রকল্পটি শিক্ষার্থীদের বিপথে যাওয়া থেকে রোধ করবে। চট্টগ্রামের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কাজ শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অন্যান্য জায়গায় চালু করা হবে। বর্তমানে প্রকল্পের কর্মীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। এর মধ্যে রয়েছে— শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবারের আয়, মনস্তাত্ত্বিক, বিনোদনমূলক ও সামাজিক অবস্থা সংক্রান্ত তথ্য।
বর্তমানে চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১১টি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। পরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে। তাতে তুলে ধরা হবে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ পরবর্তী পদক্ষেপ।
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রধান সমস্য, পড়ালেখায় মনোনিবেশ না করা ও খারাপ কাজে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে আসবে। এছাড়াও সন্তানের ব্যাপারে মা-বাবা কতটা উদাসীন তাও জানা যাবে এর মাধ্যমে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোরদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে। যেমন— মাতাপিতার অযত্ন-অবহেলা, উদাসীনতা, স্নেহহীনতা, সন্তানকে প্রয়োজনীয় ধর্মীায় ও নৈতিক শিক্ষাদানে অমনোযোগিতা, পারিবারিক পরিমণ্ডলের ঝগড়া-বিবাদ, দারিদ্র্য, সুষ্ঠু বিনোদনের সংকট, মোবাইলে পর্নো দেখা, ঘর থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া, ধূমপান করা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, সামাজিক অসাম্য, দুঃখ-দুর্দশা, যথাযথ তদারকির ঘাটতি, অবিচার, আশৈশব দুর্ব্যবহার প্রাপ্তি, কুসংস্কার ও কুসঙ্গ, অতি আদর, আর্থিক প্রাচুর্য ও অনিদ্রার মতো বিষয়গুলো কিশোরদের অপরাধী করে তোলে। এ কারণে বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঝরে পড়ছে। ব্যাহত হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাময় শিক্ষাজীবন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিশোর অপরাধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে এ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের প্রতিবন্ধকতা নিরসনের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করে। তার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তাহমিনা আক্তার টফি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কিশোর অপরাধের ধরণ, কারণ, পরিবারের ভূমিকা, সমাজের ভূমিকা অথবা সমাজ সংশ্লিষ্ট যে বিষয়গুলো আছে যেগুলো কিশোর অপরাধকে বাড়িয়ে তুলছে। তা অনুসন্ধান করা অবশ্যই প্রয়োজন। শুধু তথ্য-উপত্ত সংগ্রহ করলেই হবে না; ভবিষ্যৎ পলিসি কি হবে, কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সেগুলো অতীব জরুরি। শুধু গ্রহণ করার জন্য গ্রহণ করা নয় এর বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।’
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ জানান, মন্ত্রণালয়ের এমন উদ্যোগে স্কুলের শিক্ষক থেকে অভিভাবকরা অনেক খুশি। বর্তমানে স্কুলে স্কুলে গিয়ে মাঠকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছেন।