হঠাৎ ছুটি বাতিল হওয়ায় ক্লাস উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
দেশের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও থাকে গ্রীষ্মকালীন লম্বা ছুটির আমেজ। রীতিমত এবারও সেই আমেজে ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে তাদের কারোমধ্যেই সেই আমেজ থাকলো না আর বেশিক্ষণ।
হঠাৎ ঘোষণায় এবারের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করেন শিক্ষামন্ত্রী। সবার মধ্যে দীর্ঘ এই ছুটি কাটানোর আমেজ থাকলেও হিজরি নববর্ষের ছুটির পাশাপাশি নিয়মানুযায়ী প্রতিষ্ঠান সমূহের সাপ্তাহিক ছুটির গ্যাপ দিয়েই আবার ক্লাসে ফেরার পালা। তবে এবারের ছুটি বাতিল হওয়া এই ক্লাসের দিনগুলোতে ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
শিক্ষাপঞ্জী অনুযায়ী ২২ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত এবারের গ্রীষ্মের ছুটি হওয়ার কথা ছিল। তার আগে ২০ জুলাই হিজরি নববর্ষ, ২১ তারিখ শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটি এবং ২২ তারিখ একইসাথে সাপ্তাহিক এবং গ্রীষ্মের ছুটি ছিল। গ্রীষ্মের ছুটি বাতিল হওয়ায় ২৩ জুলাই থেকেই ক্লাসে ফিরতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। অন্যান্যবারের মত এবারের লম্বা ছুটি নিয়ে এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের বিভিন্ন পরিকল্পনা থাকলেও ভেস্তে গেছে ছুটি বাতিলের ঘোষণায়। এতে শিক্ষার জন্য ভালো হলে তা মানতে আপত্তি নেই কারো।
আরও পড়ুনঃ ঢাবির বিজ্ঞান ইউনিটের দ্বিতীয় মনোনয়ন স্থগিত
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষক বলেছেন, এবারের ছুটি নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল। তবে হঠাৎ ছুটি বাতিলের ঘোষণা আসাতে পরিকল্পনা সব পরিকল্পনাই রয়ে গেলো। একটু মন খারাপ হলেও সরকারের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এজন্য শিক্ষার্থীদের উপকার হলে তা নিয়ে কোন আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন এই শিক্ষক।
কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছুটি বাতিলের ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা। শিক্ষকরা মনে করছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ছুটি বাতিল করে ক্লাস চালু রাখলেও প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে কম হতে পারে।
শেষ ঈদে চাকরিজীবীদের অনেকে ঢাকায় ঈদ করে পরবর্তী গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজ ছুটি হলে গ্রামে বেড়াতে যাবেন বলে ভেবে রাখেন কেউ কেউ।
জানা যায়, ঢাকাতে পরিবার নিয়ে ঈদ করেছেন এক পরিসংখ্যান কর্মকর্তা। নোয়াখালীতে তাদের গ্রামের বাড়ি। ছেলের স্কুল ছুটি হবে বলে ২০ জুলাই রাতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কিনে রেখেছেন। ছুটি বাতিল হলেও পরিবার নিয়ে গ্রামে গেছেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে পোস্ট দিয়ে ওই পরিসংখ্যান কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘রবি, সোমবার ছুটি নিলাম। ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বহুদিন পর গ্রামে এলাম। পরিকল্পনা ছিল ছেলেকে কিছুদিন নানাবাড়ি ও দাদাবাড়িতে গ্রামের পরিবেশে ঘুরতে সুযোগ করে দেবো। আমি মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরবো, আর ওদের আরও এক সপ্তাহ গ্রামে রাখবো। কিন্তু ছেলের ছুটি বাতিল হওয়ায় সবাইকে এখন ফিরতে হবে। ওর (ছেলের) ভীষণ মন খারাপ।’
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী গণমাধ্যমকে বলেন, দ্রুত ছুটি বাতিলের নোটিশ করায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যথারীতি উপস্থিত থাকবে। তিনি বলেছেন, ‘এ সিদ্ধান্ত তো সরকারের। যথাসময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার জন্য ছুটি বাতিলের কথা জানানো হয়েছে। আমরাও দ্রুত নোটিশ করে দিয়েছি। আশা করছি বাচ্চারা (শিক্ষার্থী) যথারীতি ক্লাসে আসবে।’
শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ২০ জুলাই থেকে ছুটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে এবারের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এই ঘোষণা করেন। ডিসেম্বরে শীতকালীন ছুটির সঙ্গে এ ছুটি সমন্বয় করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
ওইদিন রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সাইফুর রহমান খানের স্বাক্ষরে এই সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়। ওই আদেশে বলা হয়েছে, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে আগেই ঘোষিত ২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক/দাখিল, উচ্চ মাধ্যমিক/আলিম এবং কারিগরি/সমমনা পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হলো।’
এই আদেশে আরও বলা হয়, ‘২০ জুলাই বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আগামী ২৩ জুলাই রোববার থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম যথারীতি চালু থাকবে। বাতিলকৃত গ্রীষ্মকালীন ছুটি আগামী শীতকালীন ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও নির্দেশনা দেওয়া হয়, ‘আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠদান ও মূল্যায়নসহ অন্যান্য শ্রেণির পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে হবে।’
একদিকে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল, অন্যদিকে শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন। দুই মিলে ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কামুক্ত হওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলনরত শিক্ষকরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে যারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, তারা ক্লাসে ফিরছেন না। ফলে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা, তা কাটছে না।
শিক্ষকদের আন্দোলন চলতে থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের আশ্বাস না পেলে আমরা ফিরছি না। তিনি যত দ্রুত আমাদের ডেকে পাঁচ মিনিট সময় দেবেন, তত দ্রুত আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো।’
গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল হলেও ক্লাস হওয়ার নেই বলে জানান শেখ কাওছার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে তালা দিয়েই তো গত ১১ জুলাই থেকে আমরা আন্দোলন করছি। ছুটি তো ছিল ২০ জুলাই থেকে। তার আগেই আমরা ক্লাস বর্জন করে প্রেস ক্লাবের সামনে বসেছি। ছুটি বাতিল করে আন্দোলন দমানোর চেয়ে দাবি আদায়ে সুস্পষ্ট আশ্বাস দিলে তা শিক্ষার জন্য বেশি উপকারী সিদ্ধান্ত হতো। আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্রুত এ বিষয় বুঝবেন এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবেন।’