সৃজনশীল পদ্ধতি এখনো দুর্বোধ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে
শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর পড়াশুনার পরিবর্তে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু কতটা আত্মস্থ করতে পারছে তা যাচাই করতে ২০০৮ সালে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমিক স্তরে সনাতনি পদ্ধতির পরিবরর্তে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে সরকার। এ পদ্ধতিতে একটি উদ্দীপক দিয়ে সেখান থেকে চারটি প্রশ্ন করা হয়। এতে চিন্তার দক্ষতার বিভিন্ন স্তর যেমন জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, তুলনা ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়। বিষয়বস্তু বুঝে বুদ্ধি খাটিয়ে যৌক্তিকভাবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর করা যায়। এ পরীক্ষাপদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো। ওই সময় বলা হয়েছিল, সৃজনশীল পদ্ধতিতে নোট-গাইড থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে।
সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব ছিল শিক্ষকদের। কিন্তু শুরুর দিকে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় তারা শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও প্রশ্নপত্র তৈরিতে সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এতে কোচিং-প্রাইভেট বা গাইড বইয়ের উপর আরও নির্ভরশীলতা বেড়ে যায় শিক্ষার্থীদের। মূলত সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বোধ্যই রয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকদের মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। শুরুর দিকে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কিছু শিক্ষককে মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ খুব একটা কার্যকর হয়নি। পরবর্তীতে ছয় দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এসব প্রশিক্ষণে যারা মাস্টার ট্রেইনার ছিলেন তারাই ঠিকমতো সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝতেন কি না তা নিয়ে ওই সময় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষকদের কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতির সামগ্রিক বিষয়ে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। শিক্ষকদের মধ্যে সবাই সমান মেধা বা দক্ষতার অধিকারী নন। অথচ ইতোপূর্বে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা সবার জন্য একই ছিল। অর্থাৎ, কম দক্ষ শিক্ষকদের এগিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকেই এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বিশেষ করে প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে বিতর্ক ছিল বরাবরই। গত ৬ নভেম্বর শুরু হওয়া এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্রে এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়কে প্রশ্নের উদ্দীপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা তুমুল সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। একই দিনে অনুষ্ঠিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি (বিএম) পরীক্ষায় বাংলা–২ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিককে হেয় করার অভিযোগ উঠেছে।
সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর ১০ বছর পর ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ৪১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন বোঝেন না। মাধ্যমিক স্কুলের ৫৪ শতাংশ শিক্ষক এ পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারেননি। তাদের মধ্যে ২২ শতাংশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ পদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীদের ৯২ শতাংশ গাইড বই নির্ভর। তাদের বড় অংশ গৃহশিক্ষকের সাহায্য নেয়। শিক্ষকদের মাত্র ৪৫ শতাংশ এ পদ্ধতি বোঝে, ৪২ শতাংশ অল্প বোঝে। আর ১৩ শতাংশ বুঝতেই পারেননি সৃজনশীল পদ্ধতি।
আরো পড়ুন: এবার লেখক আনিসুল হককে হেয় করে এইচএসিতে প্রশ্ন
সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রস্তুত করা যায়নি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়নে সবার আগে প্রয়োজন ছিল সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা। বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয় বেশ চ্যালেঞ্জিং, তবে এর বিকল্প ছিল না। আমরা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি বলেন, নতুন কোনো পদ্ধতি বাস্তবায়নে তাদের নতুনভাবে প্রস্তুত হতে হয়, চিন্তায়-মননে নতুনত্ব আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ছিল। এর ফলে আমরা প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রতিফলন, কিংবা ব্যক্তি আক্রমণ লক্ষ্য করেছি, যা দুঃখজনক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. আবদুল মালেক বলেন, আমরা শুরু থেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে নানাবিধ সমস্যা প্রত্যক্ষ করেছি। এর পরীক্ষা পদ্ধতির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি উপযুক্ত ছিল না। এর পরিণাম চিন্তা না করেই বাস্তবায়ন শুরু করা হয়। বাস্তবায়নের আগে এর বস্তুনিষ্ঠ পাইলটিং হয়নি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়নি; ফলে ফলে তারা এ পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেননি। এর ফলে শিক্ষার্থীরাও সৃজনশীল পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে পারেনি। মূলত এর মাধ্যমে আমাদের শিখন ও মূল্যায়ন পদ্ধতিকে এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।