করোনা-কালে বদলে গেছে টিউশনের ধরন
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে বিকল্প উপায়ে টেলিভিশন কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রেখেছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। করোনার এই কালে প্রাইভেট টিউশনের ধারনাকেও বদলে দিয়েছে।
রাজধানীর একটি স্কুলে পড়াশোনা করেন জামাল উদ্দিনের মেয়ে হাফসা খাতুন। সে এবারে ক্লাস সেভেনে পড়ছেন। স্কুলে পড়াশোনার বাইরে হাফসার পরিবার তার জন্য অতিরিক্ত দু’জন শিক্ষক বাসায় পড়ানোর জন্য রেখেছেন। একজনে বাসায় তাকে একাডেমিক ক্লাসের পড়া শেষ করে দিতেন, অপরজন ধর্মীয় শিক্ষক। করোনাভাইরাসের পূর্বে হাফসা এভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছিলেন।
তবে দেশে করোনার বিস্তার শুরু হলে তার বাবা জামাল উদ্দিন গৃহশিক্ষকদের বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছেন। জামাল উদ্দিন বলেন, মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়লেও এখনো ছোট। এজন্য সে আমাদের কাছে পড়ার আগ্রহ পায় না। তার স্কুলের পড়ার বাইরে আমরা আলাদা দু’জন শিক্ষক দিয়ে তার দেখাশুনা করছি। করোনার শুরু থেকে তার স্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। এজন্য তার টিউশন মাস্টারদের বলে দিয়েছি আপনাদের এখন আর বাসায় আসতে হবে না; মেয়েকে অনলাইনেই কিছু কিছু সময় গাইড করেন।
করোনার শুরু থেকে প্রথম স্মার্টফোন হাতে পায় হাফসা। সে তার স্কুলের অনলাইন ক্লাসে অংশ নিয়ে যেমন আনন্দ পায় তেমনি গৃহশিক্ষকদের কাছ থেকেও। হাফসা জানায়, আমার স্কুলের শিক্ষকরা অনেক ভালো। তারা আমাদের একটা বিষয় না বুঝা পর্যন্ত নতুন আরেকটি বিষয় শুরু করেন না। গৃহশিক্ষকরা আগে পাশে বসে পড়ালেও এখন অনলাইনেই তাদের থেকে সে ধরণের সাড়া পাচ্ছি। আমার ভালো লাগছে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিউশন দিয়ে থাকেন রাজধানীর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা টিউশন’। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মারুফুল আলম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমানে টিউশনের এ সেক্টরটাতে বলতে গেলে ধস নেমেছে। অভিভাবকরা যেমন তাদের পছন্দ মতো শিক্ষক পায়না তেমনি শিক্ষার্থীরাও তাদের চাহিদা মতো শিক্ষার্থী পায় না।
তিনি বলেন, করোনার শুরু থেকে অনেক শিক্ষার্থী তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার কারণে চলমান যে টিউশনগুলো ছিল সেগুলো বাদ হয়ে গেছে। এখন আমাদের কাছে শিক্ষক আর অভিভাবক যাদের কথাই বলেন বেশিরভাগই ভিভিও কল আর অনলাইন নির্ভর টিউশন চাচ্ছেন। আমরা সাধ্যমতো ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এছাড়া অনেকে আবার নিজেদের মতো করে বিলবোর্ড দিয়েও টিউশন খুঁজে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আর্বান এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবিদ আব্দুল্লাহ সিয়াম। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বর্তমানে তিনি তার নিজ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আছেন। সেখান থেকে ঢাকায় তার টিউশনের শিক্ষার্থীদের ভিডিও কলের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারিতে অনলাইন শিক্ষা আমাদের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার একটাই মাধ্যম। আমি নিজেও একাধিক ব্যাচে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি।
তিনি বলেন, অনলাইন শিক্ষা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন একটা বিষয়। এটা আমাদের বুঝে উঠতে সময় লাগতে পারে। তবে এটা তেমন কঠিন কিছু নয়।
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় একটি স্কুলের শিক্ষক মো. সেলিম উল্লাহ। তিনি নিজে তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। একইভাবে তার দুই সন্তানও তাদের স্কুলের অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হচ্ছেন। তাছাড়াও তাদের গৃহশিক্ষকের অনলাইন ক্লাসেও যুক্ত হচ্ছেন। এতে করে দেখা যায় শিক্ষক সেলিমের বাসায় একটি অনলাইন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে মো. সেলিম বলেন, আমি নিজেও শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি। আমার ছেলে-মেয়েরাও তাদের অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হচ্ছে। আমার বাসায় বেশিরভাগ সময় ক্লাস করা এবং দেখা নিয়েই কেটে যায়। তবে বেশিরভাগ সময় ফোন কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে মানসিক সমস্যার আশংকা করছি।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খালেদা বেগম বলেন, এটা নিয়ে ঝুঁকির কোন কারণ দেখছি না। বাচ্চারা এর আগে ফোনে অনেক সময় নিয়ে গেম খেলতেন। এখানে অনলাইন ক্লাসের মাঝখানে কিছু সময় ব্রেক দিলে তারা মানসিকভাবে আবার সতেজ হয়ে ফিরতে পারবেন। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।