ভালো নেই বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা, অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে দিন
করোনাভাইরাসের ছোবলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সবকিছু। চাকরি হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। এরমধ্যে রয়েছেন বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। অনেকে চাকরি হারিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। শ্রমিক হিসেবে কাজ করার কথাও শোনা গেছে। কেউবা লোকলজ্জার ভয়ে কিছু করতে না পেরে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকারি সহযোগিতা ছাড়া বিকল্প কিছুতে ভোগান্তি লাঘবের আশা দেখছেন না তারা।
৯ হাজার টাকা বেতনে খুলনার আলহাজ সারোয়ার খান কলেজের প্রভাষক নেকবর হোসাইন চাকরি করতেন। শহরে বাসাভাড়া করে থাকতেন, টিউশনি, কোচিং করিয়ে কোনো রকম সংসার চালাতেন। করোনার কারণে বেতন বন্ধ, খরচ মেটাতে না পারায় ফিরে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। তিনি বলেন, কলেজের আয় বন্ধ, তাই বেতনও নেই। এখন টিউশনি-প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়েও ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামে বাড়িতে চলে এসেছি।
বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফোরামের সভাপতিও নেকবর হোসাইন। তিনি বলেন, বেশিরভাগ বেসরকারি কলেজের আয় খুব কম। এ কারণে শিক্ষক-কর্মচারীদের নামমাত্র বেতন-ভাতা দিত। করোনা আসার পর সেই উপার্জনও বন্ধ হওয়ায় বেতন-ভাতাও দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষকদের পাঁচ হাজার আর কর্মচারীদের আড়াই হাজার টাকা করে সরকার এককালীন প্রণোদনা দিচ্ছে। টাকাটা প্রতি মাসে দিলেও শিক্ষকরা খুশি হতেন।
জানা গেছে, দেশে বেসরকারি ও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে অন্তত ৬০ হাজার। এগুলোর মধ্যে ৪০ হাজারই কিন্ডারগার্টেন (কেজি)। আর দুই হাজার আধা-এমপিও ও বেসরকারি স্কুল। এছাড়া নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সাড়ে আট হাজার, পলিটেকনিকসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্তত ১০ হাজার এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৯৬টি।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলগুলোয় ছয় লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। কারিগরি প্রতিষ্ঠানে আছে প্রায় আড়াই লাখ। আর বেসরকারি নন-এমপিও স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় প্রায় ৯০ হাজার। ৯৬ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনবল ২৯ হাজার। এছাড়া শতাধিক ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানে আরও কয়েক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। অনার্স-মাস্টার্স কলেজে আছেন সাড়ে পাঁচ হাজার। করোনার কারণে তাদের সবারই বেতন-ভাতায় প্রভাব পড়েছে।
রাজধানী ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল সাকিব। সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পাঁচ জনের সংসার, বাবা ‘স্ট্রোক’ করে শয্যাশায়ী। প্রতি মাসে ওষুধ কিনতে হয় দুই হাজার টাকার। মার্চে আংশিক বেতন পেলেও এখন পর্যন্ত আর বেতন-ভাতা পাননি। ধার-দেনা করে সংসারের খরচ চালাচ্ছেন। আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান গত ডিসেম্বরে বিয়ে করেন। তিনিও মে মাসের বেতন পাননি। বিবাহিত জীবনের প্রথম ঈদে স্ত্রীকে কিছুই দিতে পারেননি তিনি।
তাদের মতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী করোনাকালে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বলে জানা গেছে। দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। ধার-দেনা করে চলছেন অনেকে। অনেকে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ ও ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছেন। অনেকে বাকিতে কিনে চালিয়ে নিচ্ছেন সংসার।
জানা গেছে, ক্যামব্রিয়ান ও ট্রাস্টসহ নামী বেশিরভাগ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও বেতন-ভাতা পাচ্ছে না নিয়মিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোয়ও একই অবস্থা। উত্তরার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, টিউশন ফি নিচ্ছে, কিন্তু তাদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে না।
রাজধানীর জুরাইন আইডিয়াল কিন্ডারগার্টেনের সহকারী শিক্ষক মোশারেফ হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠানের সব আয় বন্ধ। বেতন-ভাতা দূরের কথা, পরিচালক প্রতিষ্ঠানের বাড়িভাড়াও দিতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেয়ার বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কেনার মতো কেউ নেই। মার্চে কিছু প্রতিষ্ঠান বেতন দিয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান আংশিক বেতন দিয়েছে।
এ ব্যাপারে কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাড়া এবং শিক্ষকদের বেতনের সংস্থান হয় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় টিউশন ফি আদায় করতে পারেননি। তাই খরচ চালাতে পারছেন না। অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছেন। অনেকে বিক্রির চেষ্টা করছেন। আমরা সরকারের কাছে পাঁচশ’ কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়েছি। তবে সাড়া মেলেনি।
খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মাকসুদ উদ্দিন বলেন, এপ্রিলের ১৫ দিনের বেতন দিয়েছি, এরপর পারিনি। পরে যদি সামর্থ্য হয়, তাহলে বকেয়া দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব।
এদিকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিশেষ অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। গত ২৪ জুন প্রায় ৮১ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষকরা এককালীন পাঁচ হাজার টাকা এবং কর্মচারীরা দুই হাজার পাঁচশ’ করে অনুদান টাকা পাবেন। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীরাও সহায়তা পাবেন বলে জানা গেছে।