স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আরও বন্ধ চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে চলছে অঘোষিত লকডাউন। ব্যাংক এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানসমূহ ব্যতীত প্রায় সকল অফিস, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা, গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়ে তা আগামী ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে।
এ ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়লেও সম্প্রতি কিছুটা শিথিল করা হয়েছে এই লকডাউন। সম্ভাবনা রয়েছে আগামী ১ জুন থেকে সীমিত পরিসরে সকল ধরনের অফিস-আদালত এবং ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার। এদিকে, পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা মেনে প্রতিষ্ঠান চালাতে বলা হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে গেলে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়, তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে যে জটলা সৃষ্টি হবে তা কীভাবে সমন্বয় করা হবে তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সুস্থ আছেন কিনা- তা যাচাই করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কারোনা রোগ নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও খুলে দেয়া হলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিপক্ষে। তাদের মতে, দেশে করোনা পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। আর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় তাহলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন মাহি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াটা কোনো যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবেনা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলবে। তার মতে, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সচেতন এবং তারা এই ধরনের ধংসাত্মক সিদ্ধান্ত কখনোই মেনে নেবে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারেক আজিজ বলেন, আমি মনে করি এই মুহুর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। বাংলাদেশ যদি হার্ড ইমিউনিটির দিকে যেতে চায় তাহলে সুইডেনের মত মাস ক্যাজুয়ালিটি হতে পারে। আর একটি দেশের ছাত্ররা সবচেয়ে পটেনশিয়ালটি সম্পন্ন জনগোষ্ঠী। তাই ছাত্রদের সুস্বাস্থ্যের দিকটি অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। জাতিগতভাবে আমরা যেন পিছিয়ে না যায়, সেই দিকটা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যেতে পারে বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী। তার মতে, অনেকেই ঘরে থেকে বিরক্ত, তারা হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ফিরে যাবে। তবে ক্লাসে যোগদান নাও করতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহসান জোবায়ের বলেন, পহেলা জুন পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি যদি অপরিবর্তিত থাকে তাহলে শুধু অফিস আদালত নয়, যে কোন প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তই বুমেরাং হবে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, যে কোন প্রতিষ্ঠান খোলারই বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দরকার উল্লেখ করে তিনি।
জোবায়ের বলেন, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবগুলোই একই সুত্রে গাঁথা। একটা বন্ধ রেখে আরেকটা খুলে দিলে ঘুরে ফিরে মানুষের সংস্পর্শে করোনাভাইরাস সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে। তাই বন্ধ রাখলে সবকিছুই বন্ধ রাখতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম তুহিন বলেন, যদি বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়; তবে তা হবে অযৌক্তিক ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সীমিত পরিসরে নিয়মকানুন মেনে অফিস, দোকানপাট খোলা যেতে পারে। তবে কোন অবস্থাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ খোলা উচিত নয়। আর যদিও খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাতেম আলী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস-আদালত খোলা উচিত। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই মুহুর্তে খোলা উচিত হবে না। আর কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ শিক্ষার্থী হল বা মেসে থাকে। তাদের কেউ আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললেও এ সময় ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে সকল ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ আহমেদ দিগন্ত বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সেটিকে অযৌক্তিক একটি সিদ্ধান্ত বলবো। আমাদের দেশে করোনা রোগীর আক্রান্তর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তাই এ ধরণের সিদ্ধান্ত আত্মাঘাতী সিদ্ধান্ত হবে। আর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাও হয় তাহলেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই ক্লাসে ফিরবে না কিংবা তাদের অভিভাবকরা ফিরতে দিবে না। এমনকি আমিও ব্যক্তিগতভাবে ক্লাসে ফিরতে চাই না।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ এম মাইনুদ্দীন পাঠান বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সচল রাখতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করা যায়। তবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি যেহেতু দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা উচিত। আর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয় দেখা যাবে কিছু শিক্ষার্থী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাসে ফিরলেও অনেক শিক্ষার্থী বাসা থেকে বের হবেনা অথবা পরিবার থেকে যেতে দেবেনা, এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও নিয়মবিধি বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে উঠবে।
তবে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থী তাওহীদ ইসলাম কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু চালু করা জরুরি। তার মতে, মানুষকে ঘরের বাইরে বের হতে হবেই কারন সকল ধরনের সেবা ঘরে পৌছে দেয়ার মত উন্নত বা সুগঠিত ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই সব কিছু চালু করা জরুরি।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে যেমন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন স্টেশন, সরকারী বেসরকারী অফিসসহ সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দ্বারা ইউনিট আকারে ভাগ করে জীবানুনাশক বুথ বসানো ও তা সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া জরুরিভাবে প্রত্যেক উপজেলায় সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল বা তার শাখা স্থাপন করতে হবে, যা সাধারণ হাসপাতাল থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠান আরো বন্ধ চান। রাজধানীর তালতলা কলোনীতে পড়ুয়া কলেজ শিক্ষার্থী আদনান বলছিলেন, মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে ভীতি কেটেছে, কিন্তু আক্রান্ত কমেনি। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও বাবা-মা যেতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে। সামাগ্রিক দিক বিবেচনা করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সীমা আরো বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন এই ছাত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর মিরপুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, দেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পক্ষে তিনি।