০৫ অক্টোবর ২০১৮, ০৩:২২

শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি: আলোর ছোঁয়ায় অনেক অর্জন

বিনামূল্যের বই হাতে হাস্যোজ্জ্বল শিক্ষার্থীরা  © ফাইল ফটো

শিক্ষা ক্ষেত্রে ৯ বছরে যুগান্তকারী পরিবর্তনের মূলে রয়েছে শিক্ষানীতি প্রণয়ন, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া, প্রায় সব শিশুকে স্কুলমুখী করানো, মাধ্যমিক পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সমতা অর্জন, উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এসব পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক অর্জনও রয়েছে। অর্জনগুলো একদিকে যেমন দৃশ্যমান, অন্যদিকে ক্রমাগত ঝুঁকির মুখেও রয়েছে। তারা বলেন, যে কোনো অর্জনের সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও অর্জনের সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। শিক্ষা ক্রমাগত পণ্য হয়ে যাওয়া; বিনিয়োগ না বাড়ানো; দক্ষ শিক্ষকের অভাব; শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। তবে সরকার চেষ্টা করলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

জানা যায়, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর দেশের সব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। একই সঙ্গে জনগণের দোরগোড়ায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছানো, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো, পরিবেশ সুরক্ষা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচির মধ্যে ছিল স্কুলে যাওয়া বয়সি শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে আনয়ন, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ, স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল চালু করা, মেয়েদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ এবং শিক্ষা সহায়তা উপবৃত্তি প্রদান, সব শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা বৃত্তি প্রদান, পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করা এবং আইটিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনসহ শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া ও ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিতকরণ।

প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ক্রমেই কমছে : বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৭’ শীর্ষক এক জরিপে দেখা গেছে প্রাথমিকে শিশু ঝরে পড়ার হার ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ২০০৮ সালে এ চিত্র ছিল ৪৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার কমছে : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও ঝরে পড়ার হার কমছে। ব্যানবেইস পরিচালিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১৭’ জরিপে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০০৮ সালে এ চিত্র ছিল ৬১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। অন্যদিকে, উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৭ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ২০০৮ সালে এ চিত্র ছিল ৪৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

প্রায় শতভাগ স্কুলে মিড ডে মিল চালু : প্রাথমিকে শিশুভর্তির হার বৃদ্ধিকরণ, উপস্থিতির হার বাড়ানো, ঝরে পড়ার হার হ্রাসকরণ এবং শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্কুলে স্কুলে মিড ডে মিল চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের ৯৮ শতাংশ সরকারি স্কুলে মিড ডে মিল চালু হয়েছে বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান।

প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত উপবৃত্তি : শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাঁচটি প্রকল্পের আওতায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত দরিদ্র ও মেধাবী এবং প্রাথমিকে শতভাগ শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এর মধ্যে সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট এবং মাধ্যমিক শিক্ষা খাত উন্নয়ন প্রকল্প নামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রকল্প চালু আছে। এ পর্যন্ত প্রথম থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত মোট ১ কোটি ২২ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন : অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের জন্য ২০১১ সালে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে।

কলেজ সরকারীকরণ : যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই, সেগুলোয় একটি করে কলেজ জাতীয়করণের জন্য ২০১৬ সাল থেকে তালিকাভুক্তির কাজ শুরু করে সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে দেশের ২৭৬টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪৬টি কলেজ সরকারীকরণ করা হয়। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬০৩টি। বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন শিশুদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার মধ্যদিয়ে সারা দেশে পালন করা হয় পাঠ্যবই উৎসব।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের হাতে মাতৃভাষায় পাঠ্যবই : ২০১৭ সালে প্রথম বারের মতো চাকমা-মারমা-গারোসহ পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, পাঠদানও করা হচ্ছে। সাঁওতালদের জন্যও আরেকটি করতে যাচ্ছে। সেটার যাচাই-বাছাই চলছে। একই সঙ্গে প্রথমবারের মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল বই সরবরাহ করা হয়েছে।

শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জন : একসময় নারী শিক্ষা ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ও শহরের কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। মেয়েদের বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগে ও উপবৃত্তি এ অগ্রগতিকে বেগবান করেছে।

ই-বুক আকারে পাঠ্যপুস্তক : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের সব পাঠ্যপুস্তক এখন ই-বুক আকারে পাওয়া যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইট ডায়নামিক করে, ই-বুক ভার্সনে উন্নয়ন করে মাধ্যমিক স্তরের ৫০টি বাংলা ভার্সন, ২৬টি ইংরেজি ভার্সন ও প্রাথমিক স্তরের ৩৩টি পাঠ্যপুস্তক তাতে আপলোড করা হয়েছে। এর ফলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ, যে কোনো সময় এসব পাঠ্যপুস্তক ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে।

অনলাইনে ভর্তি ও পরীক্ষার ফল : শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনলাইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলসহ শিক্ষক নিয়োগ ও নিবন্ধন পরীক্ষার ফল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে। মোবাইল ফোনের এসএমএস এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের ই-মেইলের মাধ্যমেও এই ফল অতি দ্রুত প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে অনলাইনে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটি : শিক্ষা ব্যবস্থায় আইসিটির ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। সরকার আইসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্ল্যান (২০১২ থেকে ২০২১) প্রস্তুত করেছে। এছাড়া ই-লার্নিং কার্যক্রম, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তৈরিসহ দক্ষ ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ‘দি আইসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণে নানা পদক্ষেপ : ২০০৯ থেকে সর্বশেষ অর্থবছর পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫১টি, পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৪২, সিডর-সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে ৩৮২, অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে ৪০ হাজার ৫৬৫, বড় ধরনের মেরামত করা হয়েছে ৫ হাজার ৪৭১ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৬১৪টি। নতুনভাবে পিটিআই নির্মাণ করা হয়েছে ১১টি এবং আরেকটি ঢাকায় নির্মাণাধীন।

কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন : বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭২টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। এছাড়া, ৩১০টি মডেল স্কুল, ৭০টি স্নাতকোত্তর কলেজ, ২০টি সরকারি বিদ্যালয় এবং ৩৫টি মডেল মাদ্রাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।

কওমি সনদের স্বীকৃতি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় অভাবনীয় পরিবর্তন : স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, আলাদা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমান সুযোগ, ৫২টি মাদ্রাসায় বিষয়ভিত্তিক অনার্সের সুযোগ, ৩৫টি মাদ্রাসাকে মডেল মাদ্রাসায় রূপান্তর, কওমি মাদ্রাসার সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি, মাদ্রাসা সিলেবাসকে আরও উন্নত ও আধুনিক করার ফলে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, অর্জনগুলো একদিকে দৃশ্যমান হলেও সেগুলো ক্রমাগত ঝুঁকির মুখে পড়ছে। শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে- সেটা হলো শিক্ষা ক্রমাগত পণ্য হয়ে গেছে। বিশেষ করে, পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা হওয়ার কারণে শিক্ষা ক্রমাগত ব্যয় বহুল হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী, সরকার চেষ্টা করলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগামীতে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, জার্মানভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, শিক্ষার মানের মাপকাঠি হচ্ছে শিক্ষার্থীরা যেখানে পড়ে, তার পরিবেশ কি মানসম্মত, যে সিলেবাসে পড়ে সেটা কি মানসম্মত, শিক্ষক কি মানসম্মত পড়াচ্ছেন? কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে আমাদের প্রচলিত যে ধারণা, সেটা সঠিক নয়। তাই আমি বলব, শিক্ষার মান বেড়েছে ও একই সঙ্গে কমেছে; দুইটাই হয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বর্তমানে প্রায় সব শিশু স্কুলে যাচ্ছে, মাধ্যমিক পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে সমতা অর্জিত হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, প্রতিটি শিশুকে বছরের প্রথম দিনে বই দেওয়া হচ্ছে, ঝরে পড়ার হার কমছে প্রভৃতি।