মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে মেসবাহ কামালের বক্তব্যটি ২০১৮ সালের
মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামালের পুরানো একটি বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। বক্তব্যটি ঘিরে আবারও তীব্র বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। পরে বক্তব্যটি ঘিরে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হলে ড. মেসবাহ কামাল দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
জানা যায়, গত মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফলে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর প্রথম হওয়ার পর বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ফেস দ্যা পিপল নামে একটি নিউজ পোর্টালে পুরানো এ সংবাদটি নতুনভাবে প্রচার করা হয়। এরপর সেই বক্তব্যটি আবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। বক্তব্যটি ঘিরে আবারও দেখা দেয় তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনা।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৯ মিনিটে ফেস দ্যা পিপলের ফেসবুক পেজে সেই নিউজটি শেয়ার দেওয়ার পর এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৮ হাজার ৪০০ লাইক, ২ হাজার ৯০০ কমেন্ট এবং ৫৩৪ বার শেয়ার হয়েছে।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন উচ্চতর মাদ্রাসা: ড. মেহবাহ কামাল’- শিরোনামে সেই নিউজের ইন্ট্রোতে বলা হয়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা উচ্চতর মাদ্রাসায় হায়ার মাদ্রাসায় পরিণত হতে দেখছি। এবং এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ গতকাল বুধবার প্রেস ক্লাবে পলিটিক্যাল ইকোনমি অব মাদ্রাসা এডুকেশন ইন বাংলাদেশ শিরোনামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সময় এসব কথা বলেন ড. মেসবাহ।”
এছাড়া নিউজের শেষে বলা হয়, “উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিবছরই বিভিন্ন ইউনিটে প্রথম স্থান অধিকারসহ বিপুল পরিমাণ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন। চলতি বছরেও গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘খ’ ইউনিটে প্রথম হয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।”
ফেস দ্যা পিপলের নিউজটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বনাম শিক্ষা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। তখন তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে এ বক্তব্যটি রেখেছিলেন। এরপর তীব্র সমালোচনার মুখে ১ ফেব্রুয়ারি দুঃখ প্রকাশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে ‘উন্নত মাদ্রাসা’ সংক্রান্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন মেসবাহ কামাল।
ওই পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, “মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে প্রফেসর ড. আবুল বারকাত ও তার সহ-গবেষকগণের লেখা একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সম্প্রতি আমি যে বক্তব্য দিয়েছি, তাতে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমি কিছুই বলিনি। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি জানি যে, মাদ্রাসা শিক্ষা এদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা। তাছাড়া উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মওলানা ভাসানী (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পাশাপাশি যে দুজন আমার পরম শ্রদ্ধেয়) তারা দুজনেই মাদ্রাসায় পড়েছেন।”
তিনি বলেন, “মাদ্রাসা ছাত্রদের হেয় করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না, কেননা সকল ছাত্রই আমার কাছে সমান। বরং শিক্ষক হিসেবে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে মাদ্রাসা থেকে আসা, ব্যতিক্রম বাদে, বেশিরভাগ ছাত্রদের ভাষাগত ভিত্তির দুর্বলতার কথা বলেছি। আমাদের ছাত্রদের অনেকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্বল ইংরেজি নিয়ে প্রবেশ করে, তখন আমরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হই। তাই মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করা দরকার সেটাই আমার বক্তব্য ছিল। মাদ্রাসা শিক্ষা অবশ্যই এ দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা। কিন্তু এখান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ভিত্তিমূল মজবুত করার জন্য তাদের মূল ধারার সাথে সংগতি রাখতে হবে। মাদ্রাসা থেকে একসময় অনেক বরেণ্য শিক্ষাবিদ, যেমন আমার শিক্ষক ড. মফিজুল্লাহ কবির বেরিয়ে এসেছেন। মাদ্রাসা থেকে এখনও কিছু ভালো ছাত্র আমরা পাই, তবে তারা ব্যতিক্রম। আমি মাদ্রাসা শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিকে সমর্থন করি, মাদ্রাসা ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলি এবং মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থায়ন বৃদ্ধিকে সমর্থন করি। ঐ অনুষ্ঠানে আমার দেয়া ১৮ মিনিটের বক্তব্যে সেসব কথা বলেছিলাম। আগে-পিছে বাদ দিয়ে আংশিক বক্তব্য শুনে যথার্থ ধারণা পাওয়া যায় না। মাদ্রাসা ছাত্রদের কর্মসংস্থান ও জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে মাদ্রাসাকে শিক্ষার মূল ধারার সাথে সমন্বিত করা দরকার।”
মেসবাহ কামাল আরও লিখেছিলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি- এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা থেকে নম্বর সংযুক্তি ব্যবস্থা বাতিল করে সরাসরি পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তিযোগ্য ছাত্রছাত্রী নির্বাচন করা হলে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমসহ সকল ছাত্রছাত্রী সমান সুযোগ পাবে। আমি এটাই বলতে চেয়েছি। আমার বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং বাহিরের ছাত্রছাত্রীসহ অন্যান্য যারা কষ্ট পেয়েছেন তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার কাছে সকল ছাত্রই সমান, তা সে যে ধারা থেকেই আসুক না কেন।”
অধ্যাপক মেসবাহ কামালের পুরনো বক্তব্যটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে একটি স্ট্যাটাস দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। বৃহস্পতিবার রাতে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাফল্যের প্রসংশা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুনও এ নিয়ে স্ট্যাটাস দেন। তিনি লিখেছেন, এটি একটি পুরোনো বক্তব্য নতুন করে সামনে এসেছে। বক্তব্য পুরোনো হলেও তামাদি হয়ে যায় না। আলোচনা হতেই পারে। এই বক্তব্যের দুটি গুরুতর সমস্যা আছে। ১) এই রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি স্বীকৃত মাধ্যম হলো মাদ্রাসা শিক্ষা। সেই স্বীকৃত মাধ্যমকে এমন ঢালাওভাবে ছোট করা গুরুতর অন্যায়। এটা উনি করতে পারে না। ২) যদি উনার মন্তব্য সত্যি বলে ধরেই নেই তাহলে সমস্যাটা আসলে কার? উনার কথার অর্থ দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এমন মানের হয় যে চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে মাদ্রাসার ৬০% শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে যেতে পারে। এইটাতো গুরুতর সমস্যা।
এক স্ট্যাটাসে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক আব্দুন নূর তুষার অধ্যাপক মেসবাহ কামালের পুরনো বক্তব্যটি শেয়ার করে লিখেছেন, “তার মানে ঢাকা ভার্সিটির অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী চতুর্থ শ্রেণির ইংলিশ জেনেই ভর্তি হয়? এই হলো তাদের ভর্তি পরীক্ষার মান? নিজেই নিজের অপমান করে। উর্দ্ধং নিক্ষেপং নিজ লালা, পতনং স্ব মুখঃ সজোরং শালা। এই ভার্সিটির সংস্কৃত বিভাগ নিয়ে সংবাদের প্রেক্ষিতে চান্স নিয়ে ভুলভাল সংস্কৃত লিখে দিলাম।”
২০১৮ সালের প্রকাশিত বিভিন্ন পোর্টালের নিউজগুলো দেখুন