প্রশাসনিক কাজের পাশেও মানবিকতায় অনন্য ইউএনও
দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্ত একটি উপজেলা নবাবগঞ্জ। ৩১৭ দশমিক ৫৪ বর্গকিলোমিটারের উপজেলায় ৯ টি ইউনিয়নের ২৮২ টি গ্রামে প্রায় ৪ লক্ষাধিক লোকের বাস। উপজেলায় এখনো ৫৪৫ কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। উপজেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৫০ হাজারের বেশি হতদরিদ্র লোকের বাস এ উপজেলায়।
এ অবস্থায় করোনার প্রভাবে পুরো উপজেলায় সামাজিক দুরত্ব বজায় নিশ্চিত করা ও প্রায় অর্ধলক্ষাধিক কর্মহীন লোকের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করা একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় প্রশাসনের পক্ষে। কিন্তু একজন নারী হয়েও সেই চ্যালেঞ্জ খুব সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুন নাহার।
ইউএনও নাজমুন নাহার জানান, করোনার বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা ছিলো সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা। এটি নিশ্চিত করতে করোনা বিস্তারের সাথে সাথেই তিনি উপজেলার নয়টি দপ্তরের কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিয়নে দায়িত্ব দিয়ে চিকিৎসকসহ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়ে কুইক রেসপন্স টিম গঠন করেন। সেই টিম ইউপি সদস্য এবং গ্রাম পুলিশদের সহযোগিতায় প্রতিটি গ্রাম থেকে যে সমস্ত ব্যক্তি নবাবগঞ্জের বাহিরে অবস্থান করেন এবং বাহির থেকে নবাবগঞ্জে এসেছেন তাদের তালিকা তৈরী করেন। সেই তালিকা ধরে যখনই কোন বাহিরের ব্যক্তি নবাবগঞ্জে প্রবেশ করেছেন তাঁকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিশ্চিত করেছেন। বাহির থেকে আসা উপসর্গ থাকা প্রতিটি ব্যক্তিরই নমুনা সংগ্রহ করে করোনা পরীক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে কাজ করেছে কুইক রেসপন্স টিম।
সরকারের দেওয়া বরাদ্দের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সার্বিক সহযোগিতায় প্রকৃত কর্মহীনদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন।
দরিদ্র ব্যক্তির পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে গঠন করেন তিনটি ভ্রাম্যমান বাজার। তিনিটি খোলা মিনি ট্রাকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি হতো প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী। সেখানে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ন্যায্য মূল্যে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করা হতো। এতে করে উপজেলার হাট বাজার গুলোতে চাপ কম পড়ায় সামাজিক দুরত্ব । ভ্রাম্যমান বাজারের ট্রাকের খরচ বহন করতো উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলার ২৫ টি হাট বাজারসহ পুরো উপজেলায় সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করতে গত ২৫ মার্চ থেকে ৭ মে পর্যন্ত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৬৫ টি ভ্রাম্যামান আদালত পরিচালিত হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, করোনার দিনগুলোতে সামাজিক দুরত্ব, স্বাস্থ্য সেবা এবং খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে দিনরাত ছুটে চলেছেন ইউএনও নাজমুন নাহার। উপজেলর যেকো প্রান্ত থেকেই কোন সহযোগিতার ডাক এসেছে সেই প্রান্তেই ছুটে চলেছেন তিনি।
প্রশাসনিক কাজের পাশেও মানবিকতায় অনন্য ইউএনও নাজমুন নাহার। গত ২ মে উপজেলার ভাদুরিয়া বাজার এলাকায় ধানক্ষেত থেকে একটি নবজাতক উদ্ধার হয়। ইউএনও নাজমুন নাহার তৎক্ষণাৎ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নবজাতকটিকে নিজের মাতৃস্নেহে গ্রহন করেন।
উপজেলার ভাদুরিয়া ইউনিয়নের সাতানি জামিরা আশ্রয়ন প্রকল্পের ভ্যান চালক মোজাম্মেল হক জানান, তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য। ভ্যান চালিয়ে চলে তাঁর সংসার। একদিন বাড়িতে কোন খাবার না থাকায় অন্যজনের সহায়তায় মুঠোফোনে ইউএনওর কাছে খাদ্য সহায়তা চান। কিছুক্ষণ পরেই ইউএনও নিজেই তাঁর বাড়িতে খাদ্য সহায়তা নিয়ে হাজির হন।
কুশদহ ইউনিয়নের রবিদাস বিজয় জানান, তাঁর সেলুন বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে খুব অসহায় পড়েন তিনি। একদিন রাতে বাড়িতে এসে দেখতে পান কোন খাবার না থাকায় সকলেই উপোষ হয়ে রয়েছেন। তৎক্ষণাৎ এক প্রতিবেশির মাধ্যমে ইউএনওকে ফোন দিলে রাতেই তাঁর বাড়িতে খাবার নিয়ে হাজির হন ইউএনও।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. রেফাউল আলম জানান, করোন মোকাবেলায় সরাকারের দেয়া প্রতিটি বরাদ্দ সুষ্ঠ বন্টনে ইউএনও নাজমুন নাহারের অনন্য উদ্যোগের কারনে প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে সকল কর্মহীনদের মাঝে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সার্বিক সহযোগিতা পৌছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সায়েম সবুজ জানান, স্থানীয় সাংসদ শিবলী সাদিকের সার্বিক পরামর্শক্রমে ইউএনও নাজমুন নাহার করোনা মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন। সেই সাথে একজন নারী হিসেবে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে নবাবগঞ্জে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পারুল বেগম জানান, করোন ভাইরাস প্রতিরোধ এবং খাদ্য সহায়তাসহ আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য সেবা ও সরকারের সার্বিক দিক নির্দেশনা প্রতিপালনে ইউএনও নাজমুন নাহার অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।