১২ বছরে আবেদন বেড়েছে চার গুণ, চেয়ারম্যান জানালেন ৫ কারণ
দেশে সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পরীক্ষা হলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)। দিন যত যাচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে এ পরীক্ষার আবেদন সংখ্যা। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নানা ধরণের নীতিমালা এবং নতুন নতুন পে-স্কেলের কারণে চাকরিপ্রার্থীদের প্রথম ও একমাত্র স্বপ্ন হয়ে উঠেছে বিসিএস। অন্যদিকে প্রার্থী সংখ্যা বাড়ার ফলে দিনকে দিন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বিসিএস ক্যাডারের এই পরীক্ষা।
চাকরিপ্রার্থীদের কাছে কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিসিএস— জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান পিএসসি প্রিলি থেকে শুরু করে নিয়োগ হওয়া পর্যন্ত স্বচ্ছতা বজায় রাখে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরণের বিশ্বাস চলে এসেছে যে, কোন প্রকার তদবির ছাড়াই সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব। এটি বিসিএসে আবেদন বাড়ার অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত, আমরা যে শুধু ক্যাডার নিয়োগ দেই তা নয়, নন ক্যাডারেও ২ হাজার প্রার্থী নিয়োগ দিয়ে থাকি। ফলে অনেক বেশি প্রার্থী আবেদন করছে।
তৃতীয়ত, একজন চাকরিপ্রার্থী বিসিএস প্রস্তুতি নিলে অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতিও হয়ে যায়। অর্থ্যাৎ কেউ বিসিএস প্রস্তুতি নিলে ব্যাংক, শিক্ষক নিয়োগ এমনকি বিমানসহ বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিতে পারেন। এ কারণে একজন চাকরিপ্রার্থী বিসিএসকেই টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। এটিও বিসিএসে প্রার্থী বাড়ার অন্যতম কারণ।
চতুর্থত, উচ্চশিক্ষার পর অনেক শিক্ষার্থীই দেশের বাইরে চলে যায়। আবার অনেকের মধ্যেই দেশপ্রেম কাজ করে; ফলে তারা দেশেই থেকে যায় এবং দেশের জন্য কিছু করতে চায়। এ ধরণের বড় একটি শ্রেণি বিসিএস দিয়ে থাকে।
পঞ্চতম, বিসিএস জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেক কারণ হলো— অনেক চাকরিপ্রার্থীই নিজের দেশ, বাংলাদেশের সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিশ্ব জগৎ সম্পর্কে জানতে চায়। বিষয়গুলো জানার মাধ্যমে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে চায়।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিসিএস একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এত বিপুল সংখ্যক আবেদন প্রক্রিয়ার পরীক্ষা সম্পন্ন হতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। প্রিলিতে চার লাখের বেশি প্রার্থী আবেদন করে। তাদের খাতা দেখা, ফলাফল প্রস্তুত করা আবার উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষা সম্পন্ন করতে অনেক সময় লেগে যায়। এ কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগে। তবে আমরা এই প্রক্রিয়াটি দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা করছি।
বছর বছর কেমন বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষার্থী সংখ্যা? পিএসসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে ২৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে আবেদন সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ১৬৪ জন; যা ৩৮তম বিসিএসে এসে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জনে। আবার ৪০ তম বিসিএসে যেখানে ৪ লাখ ১২ হাজার প্রার্থী ছিল; ৪১তম বিসিএসে এসে তা ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৬৩ জনে ঠেকে। যেটাকে বিসিএস পাগলরা খানিকটা মজা করেই বলছেন- এবারের এই আবেদন সংখ্যা ৫৯টি দেশের জনসংখ্যাকে পেছনে ফেলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে ক্যাডার সার্ভিসের প্রতি প্রার্থীদের আগ্রহ বাড়ছে। একই কারণে বেড়েছে আবেদনকারীর সংখ্যাও। ২৮তম বিসিএসের তুলনায় ৪১তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। তাই পিএসসিকে বিসিএসের বাইরেও অন্যান্য জায়গায় নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাছাড়া ক্যাডার এবং নন ক্যাডারে নিয়োগের সংখ্যাও আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক এই তিন ধাপের পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের বাছাই করে থাকে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। তিন ধাপে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে পিএসসি। পরে মন্ত্রণালয় থেকে চাকরিতে যোগদানের গেজেট প্রকাশ করা হয়।
তবে বিসিএসে আবেদনের সংখ্যা যেমন আশার সৃষ্টি করে, তেমনি জন্ম দেয় হতাশারও। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা সব সময় উন্নয়নের কথা বলছি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলছি। কিন্তু আমরা বেকারত্ব নিয়ে কথা বলছি না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। তিনি বলেন, আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে- কারণ আমাদের কৃষকরা কাজ করছে, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসছে। বিসিএস থেকে আরও নতুন নতুন সেক্টরে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। ক্যাডার এবং নন ক্যাডারের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ধীরগতির কারণে চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে ফল প্রকাশ এবং চাকরিতে যোগদানের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত লাখো তরুণ-তরুণীর মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে পিএসসি। আগামীতে তাদের লক্ষ্য থাকবে ১২ মাসের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করা। এজন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে পিএসসি সূত্রে জানা গেছে।
অধ্যাপক ড. আবদুল জব্বার খানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যায়, ‘পিএসসি ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্যাডারে নিয়োগ হয়েছিল মোট ১২ হাজার ৭৯৩ জন। তবে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণে, অর্থাৎ ২৬ হাজার ১৯৫ জনে। ঠিক একইভাবে নন-ক্যাডেরে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছিল ৩ হাজার ৮৩৪ জন এবং ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে চারগুণে, অর্থাৎ ১৬ হাজার ৬২৭ জনে। গত ১৫ বছরে প্রায় ৪০ হাজার ক্যাডার নিয়োগ হয়েছে এবং ২০ হাজার নন-ক্যাডার নিয়োগ হয়েছে। সার্বিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
৪১তম বিসিএসের প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা গেছে, এবার ক্যাডার পদে ২ হাজার ১৩৫ জনকে নেওয়া হবে। তার মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারে ৯১৫ জনকে, প্রশাসনে ৩২৩ জন, পুলিশে ১০০, বিসিএস স্বাস্থ্যতে সহকারী সার্জন ১১০ জন, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ৩০ জন, পররাষ্ট্রে ২৫ জন, আনসারে ২৩ জন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে সহকারী মহাহিসাব রক্ষক (নিরীক্ষা ও হিসাব) ২৫ জন, সহকারী কর কমিশনার (কর) ৬০ জন, সহকারী কমিশনার (শুল্ক ও আবগারি) ২৩ জন ও সহকারী নিবন্ধক ৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে।
এছাড়া পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে ১২ জন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ৪ জন, সহকারী ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট ১ জন, সহকারী সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক ১ জন, সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) ২০ জন, সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) ৩ জন, তথ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী পরিচালক বা তথ্য কর্মকর্তা বা গবেষণা কর্মকর্তা ২২ জন, সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান) ১১ জন, সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক ৫ জন, সহকারী বেতার প্রকৌশলী ৯ জন, স্থানীয় সরকার বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী ৩৬ জন, সহকারী বন সংরক্ষক ২০ জন, সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল পদে ২ জন, বিসিএস মৎস্যতে ১৫ জন, পশুসম্পদে ৭৬ জন, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ১৮৩ জন ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ৬ জন, বিসিএস বাণিজ্যে সহকারী নিয়ন্ত্রক ৪ জন।
পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ৪ জন, বিসিএস খাদ্যে সহকারী খাদ্যনিয়ন্ত্রক ৬ জন ও সহকারী রক্ষণ প্রকৌশলী ২ জন, বিসিএস গণপূর্তে সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) ৩৬ জন ও সহকারী প্রকৌশলী (ই/এম) ১৫ জনসহ মোট ২ হাজার ১৩৫ জন কর্মকর্তাকে এই বিসিএসে নিয়োগ করা হবে।