বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বা ফোরেক্স রিজার্ভ কি?

মোহাইমিন পাটোয়ারী
মোহাইমিন পাটোয়ারী  © টিডিসি ফটো

অনেক সময় আমরা টেলিভিশন-পত্রিকায় দেখি— দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, তার কিছুদিন পর দেখি ৪৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে ইত্যাদি। কিন্তু আমরা কি জানি- যে সম্পদ আমাদের দেশের প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে তা আসলে কি? চলুন সরল বাংলায় ফোরেক্স রিজার্ভ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

আমরা যখন একটি দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বাণিজ্য করি, তখন টাকা ব্যাবহার করি। কারণ দেশের সকল প্রান্তে টাকা একটি গ্রহণযোগ্য বিনিময় মাধ্যম। কিন্তু আমরা যখন ভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করি কিংবা ভ্রমনে যাই, তখন দেশীয় মুদ্রা ব্যাবহার করতে পারি না। যেমন জাপান থেকে যদি আমরা একটি টয়োটা গাড়ি কিনতে চাই, সে ক্ষেত্রে টয়োটা কোম্পানিকে বাংলাদেশী টাকার বান্ডিল দিলে তা নিয়ে টয়োটা কোম্পানি মহা ফ্যাসাদে পড়বে। এ টাকা দিয়ে কোম্পানি তাদের শ্রমিকদের বেতন বা ট্যাক্স কিছুই দিতে পারবে না। কারণ জাপানে বাংলাদেশী টাকা চলে না, জাপানে চলে ইয়েন। তাই জাপানি গাড়ি কিনতে আমাদের প্রয়োজন হবে ইয়েন।

কিন্তু বাংলাদেশে ইয়েন তৈরি হয় না। আমি যদি বাজারে টাকার বিপরীতে ইয়েন কিনতে চাই হয়তো কোন গ্রাহক পাব না। কারণ একজন জাপানী ব্যাক্তি যখন ইয়েন বিক্রি করে টাকা কিনবে সে বাংলাদেশি টাকা কোন কাজে লাগাতে পারবে না, যদি না সে বাংলাদেশ থেকে কিছু ক্রয় করে অথবা বাংলাদেশে ভ্রমণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে থেকে জাপানে রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম এবং জাপানী পর্যটকও বাংলাদেশে অপ্রতুল। ফলে বাংলাদেশী টাকার গ্রাহকের শূন্যতা থেকেই যাবে।

অন্যদিকে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক যখন আমরা ইউরোপে রপ্তানি করি, তখন আমরা অর্জন করি ‘ইউরো’। কিন্তু ইউরো দিয়ে দেশের বাজারে কেনাকাটা করা বা শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব না। আবার একজন ইউরোপীয় ক্রেতার পক্ষেও বাংলাদেশী টাকা অর্জন করা সবসময় সম্ভব না। এর ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে মুদ্রার ভিন্নতা একটি বড় সমস্যা।

এই সমস্যা দূর করতে আগেরকার দিনে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যাবহার করা হত সোনা (অথবা রুপা)। যেহেতু বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ভিন্ন ভিন্ন, সেহেতু সোনা ছিল আন্তর্জাতিক লেনদেনের সাধারণ মুদ্রা। কোন দেশ পণ্য রপ্তানি করলে সেই দেশের কোষাগারে স্বর্ণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেত। আবার আমদানি করার সময় কোষাগারে থেকে স্বর্ণের পরিমাণ হ্রাস পেত। অর্থাৎ, স্বর্ণই ছিল মুদ্রা। আর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার মান স্বর্ণের বিপরীতে নির্ধারিত হত। এভাবেই চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপীয় দেশ গুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী হয়ে প্রচুর স্বর্ণ হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের দ্বারা আর টাকার বিপরীতে সোনা মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে ১৯৪৪ সালে ‘ব্রেটন উডস’ চুক্তির মধ্যে দিয়ে নতুন নিয়ম জারি করা হল, একমাত্র মার্কিন ডলারের বিপরীতে সোনা মজুদ থাকবে, ৩৫ ডলারে এক আউন্স। বাদবাকি সকল মুদ্রা ডলারের সাথে সামাঞ্জস্য বজায় রাখবে। এইভাবে মার্কিন ডলার হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ মুদ্রা। এর পর থেকে দুইটি ভিন্ন দেশ বাণিজ্য করত ডলারে। কারণ তাদের হাতে প্রয়োজনীয় স্বর্ণ নেই এবং যেহেতু ডলারের বিপরীতেই স্বর্ণ মজুদ আছে, চাইলেই ডলার ভেঙ্গে তার বিপরীতে স্বর্ণ পাওয়া সম্ভব। এক কথায় ব্রেটন উডস চুক্তির পরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার হয়ে উঠল নতুন স্বর্ণ।

তবে পরবর্তীতে আমেরিকা তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি, তারা চুক্তির উল্লিখিত পরিমাণের অতিরিক্ত ডলার তারা ছাপাতে থাকে। এই ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে ১৯৭১ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারের বিপরীতে সোনার মজুদ ব্যাবস্থা বাতিল ঘোষণা করে। এইভাবে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড এর ইতি ঘটে। বর্তমানে কোন মুদ্রার বিপরীতেই সোনা মজুদ নেই।

কিন্তু, আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যের জন্যে একটি সাধারণ মুদ্রা প্রয়োজন, যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। বর্তমানে সেই গ্রহণযোগ্য সাধারণ মুদ্রার রাজ-আসন ‘ব্রেটন উডস’ এর কল্যাণে ঐতিহাসিক ভাবেই দখল করে আছে মার্কিন ডলার। তাই কোন দেশে যখন রপ্তানি করে বা রেমিট্যান্স আয় করে তখন ডলার আয় হয়। আবার কোন দেশ যখন আমদানি করে তখন ডলার ব্যয় হয়। আর এই দুই এর পার্থক্য কোষাগার থেকে যোগ বিয়োগ করে নিতে হয়।

একটি পরিবারের আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে যেমন সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনি একটি রাষ্ট্রের ডলার আয় অপেক্ষা ব্যয় কম হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। আর এই সঞ্চয়কেই ইংরেজিতে বলে রিজার্ভ। অনেক সময় একে ফরেক্স রিজার্ভও বলা হয়ে থাকে। ফরেক্স শব্দের অর্থ হচ্ছে ফরেইন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক লেনদেন। যেহেতু আমরা বৈদেশিক লেনদেনের মাধ্যমে এই সঞ্চয় বা রিজার্ভ অর্জন করেছি তাই একে বলি ফরেক্স রিজার্ভ।

রিজার্ভ যে সবসময় ডলারেই থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। স্বর্ণের কোষাগার থেকে যেমন স্বর্ণ বিক্রয় করে অন্যান্য সম্পদ ক্রয় করা সম্ভব, ঠিক তেমনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে ডলার বিক্রয় করে ইউরো, ইয়েন বা স্বর্ণ, রৌপ্য ইত্যাদি কিনে রাখতে পারে। অনেক সময় ব্যাংক এই বিশাল অংকের রিজার্ভ কেবল ডলারে সঞ্চিত না রেখে সম্পদের ঝুলিতে বৈচিত্র বা ডাইভার্সিটি আনতে বিভিন্ন সম্পদ, যেমন ইউরো, ইয়েন, স্বর্ণ ইত্যাদিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। এই সকল সম্পদের সম্মিলিত বাজার দরের পরিমাণই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।

লেখক: নরওয়ে স্কুল অফ ইকোনোমিক্স, মানহাইম বিসনেস স্কুল, জার্মানি


সর্বশেষ সংবাদ