শিক্ষাখাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ‘শিক্ষক বাতায়ন’
শিক্ষকদের জন্য সমন্বিত প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম ‘শিক্ষক বাতায়ন’ শিক্ষা অবকাঠামো, পরিবেশ, উপকরণ, যাবতীয় প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা গ্রহণ ও প্রদানে দেশের প্রান্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। বিশেষ করে করোনাকালে এই ‘শিক্ষক বাতায়ন’ অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সরকারের এই ডিজিটাল কর্মযজ্ঞ দেশের শিক্ষা খাতের আমূল পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
শিক্ষকদের জন্য তৈরি একমাত্র ওয়েব পোর্টাল ‘শিক্ষক বাতায়ন’ (www.teachers.gov.bd) এর মাধ্যমে শিক্ষকরা তাদের তৈরিকৃত কন্টেন্ট, ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড এবং ডাউনলোড করতে পারছেন। এই বাতায়নটি বর্তমানে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে এবং পরিশীলিত রূপে তৈরি করা হয়েছে।
শিক্ষক বাতায়নে শিক্ষকরা নিজেরাই একে অন্যের প্রশিক্ষক। কেউ কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তা ব্লগে লিখে জানানো হয়। অন্যান্য দক্ষ শিক্ষকগণ সে সম্পর্কে ধারণা দেন। আবার অনেক শিক্ষক তাদের কনটেন্ট ওয়েবসাইটে আপ করে পরামর্শ চান। পরামর্শ মোতাবেক কন্টেন্টটি সংশোধন করে তাঁরা ক্লাসে যান। ঘরে বসেই শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করছেন ও একে অন্যকে পরামর্শ দিতে পারছেন।
বাতায়নের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এটুআই-এর যৌথ উদ্যোগে প্রায় ৯ লাখ শিক্ষককে ‘শিক্ষক বাতায়ন’-এ অন্তর্ভুক্তকরণের কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ‘শিক্ষক বাতায়ন’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৩২৭ জন।
এছাড়া, শিগগিরই বাতায়নে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলা ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম মুক্তপাঠ। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের একাডেমিক প্রশিক্ষণসমূহ আংশিক এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গভাবে ই-প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। একাডেমিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন সার্টিফিকেট কোর্স এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সেশন অনলাইনে সরাসরি শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এভাবে শিক্ষক বাতায়ন হয়ে উঠবে শিক্ষকদের জন্য একটি সমন্বিত প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফর্ম।
সাতক্ষীরা জেলার নওয়াবেঁকী মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মঞ্জুর-ই-এলাহী “কন্টেন্ট তৈরির টুকিটাকি” নামে নিজেই ৫২ পর্বের টিউটোরিয়াল আপলোড করেছেন। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্রিল্যান্স অ্যাপলাইড লিংগুয়িস্ট আমিন রহমান ইংরেজি শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক অডিও টিউটোরিয়াল আপলোড করেছেন। এসব টিউটোরিয়াল থেকে শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত জ্ঞান লাভ করেন। শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে ব্রিটিশ কাউন্সিলসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী পার্টনারদের দ্বারা পরিচালিত নানা প্রশিক্ষণ এবং রিসোর্স সরবরাহ করা হয়। বাতায়নের সক্রিয় শিক্ষকরাই এখন দেশে বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন । অনেকে মাইক্রোসফট এর মতো কোম্পানি থেকেও বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হচ্ছেন।
‘শিক্ষক বাতায়ন’ সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাত্র এক দশক আগেও যে শিক্ষকরা কম্পিউটার বা মোবাইলের মতো তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন না, এখন তাঁরাই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস নিতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এর পেছনে বড় অবদান রেখেছে এটুআই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এটুআই সময় উপযোগী বিভিন্ন প্রকার অনলাইন প্রশিক্ষণ চালু করায় কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই লাখ লাখ নিবেদিত শিক্ষক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
এতে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে শ্রেণিপাঠ গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। পাশাপাশি, শিক্ষকরা হয়েছেন যুগোপযোগী ও দক্ষ। শিক্ষা ব্যবস্থাও হয়েছে উন্নত। করোনাকালে ৬৪ জেলায় অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং এ পর্যন্ত শিক্ষক পরিচালিত ৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৭৫টি কনটেন্ট শিক্ষক বাতায়নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মডেল কন্টেন্ট রয়েছে ৯৫৩টি।
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার হারং উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক আয়েশা আক্তার বলেন, ‘শিক্ষক বাতায়ন’ এর মাধ্যমে আমরা শিক্ষকরা বেশি লাভবান হচ্ছি। এখান থেকে শিক্ষকদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা যখন কোন কনটেন্ট আপলোড করছি, সেখানে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক অনেকভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা আবার তা সংশোধন করে ক্লাসে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিচ্ছি। নিজেও শিখছি এবং সবাইকে শেখাতে পারছি। বর্তমানে একজন শিক্ষক প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেই নিজের প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করার সুযোগ পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এমন একটা সময়ে আমরা আছি, যখন শিক্ষা ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব কিছু ধারণা উদঘাটিত হচ্ছে, নতুন নতুন কৌশল তৈরি হচ্ছে। এসব সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে। শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে বিশেষ করে আমি অনেক লাভবান হয়েছি। করোনা শুরুর আগে বাতায়নে খুব বেশি সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর যখন অনেক সময় হাতে পেলাম, তখন থেকে শিক্ষক বাতায়নে সক্রিয় হয়ে বেশি বেশি সময় দিতে শুরু করলাম। আইসিটি সম্পর্কে আমার তেমন জ্ঞান ছিল না, শিক্ষক বাতায়ন থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ছোটধামাই উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মো. জাকারিয়া মাহমুদ বলেন, চা বাগানের একটি শ্রমিক পরিবারের শিশু ভিকারুননিসা নূন স্কুল, আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকের ক্লাস করতে পারবে এ কথাটা বললে আমাদের কাছে অবাস্তব মনে হতো। কিন্তু আজ শহর-বন্দর, প্রত্যন্ত গ্রামের শিশু-কিশোররা এসব স্কুলের শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারছে। তাদের কাছে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তারা অনেক কিছু শিখতে পারছে।
তিনি বলেন, আবার অনেক নতুন শিক্ষকও অনলাইনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, ভালো ভালো শিক্ষকদের ক্লাস দেখে নিত্যনতুন পদ্ধতি শিখে নিচ্ছেন। নিভৃতে লুকিয়ে থাকা অনেক গুণী শিক্ষকও নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন বিশ্ব দরবারে।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক তরিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে আজ আমরা অনলাইনে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছি। শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য ‘মুক্তপাঠ’ অনলাইনে ফ্রি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। এছাড়াও, বাতায়নে সেরা অনলাইন পারফর্মার অপশনটি চালু হওয়ার ফলে শিক্ষকরা বেশি উৎসাহ পাচ্ছেন। শিশু-কিশোরদের জন্যও রয়েছে কিশোর বাতায়নের অবারিত দ্বার। এখানে শিক্ষা ও বিনোদনমূলক কন্টেন্টের পাশাপাশি সংসদ টিভিতে প্রচারিত ক্লাসগুলোকে শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো এখন আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
চাঁদপুরের হামাকান্দি পল্লী মঙ্গল হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক মোহাম্মদ শওকত হোসেন শিক্ষক বাতায়নের একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি বলেন, শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে শিক্ষক’- এ শ্লোগানকে সামনে রেখে শিক্ষকদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট পিডিএফ ওয়েব পোর্টাল ‘শিক্ষক বাতায়ন’ এর শুভ সূচনা হয়েছিল। শিক্ষক বাতায়নে সদস্য হওয়ার পর থেকে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে দিনে দিনে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি। অন্য সহযোদ্ধাদের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি। এটুআইয়ের কর্মকর্তাদের সাথে বিভিন্ন মিটিং, কর্মশালা, মতবিনিময় সভার মাধ্যমে যুক্ত হতে পেরেছি। বিশেষ করে করোনাকালে অনলাইন পাঠদানসহ শিক্ষামূলক সকল কর্মকান্ডে একত্রিত হতে পেরেছি ভার্চুয়াল মাধ্যমে। শিক্ষক বাতায়নের একজন গর্বিত সদস্য হতে পেরেছি বলেই আজ আমি শুধু আমার বিদ্যালয়েই নয় বরং সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হয়ে করোনার শুরু থেকেই অনলাইন পাঠদানের সাথে যুক্ত হতে পেরেছি।
শিক্ষক বাতায়নের কার্যক্রম জেলা পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আইসিটি ও পেডাগজিতে দক্ষ শিক্ষকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে আইসিটি ফর এডুকেশন (আইসিটিফোরই) অ্যাম্বাসেডর। ইতোমধ্যে সারাদেশ হতে ১ হাজার ৪০০ জন শিক্ষককে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনগুলো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আইসিটিফরই অ্যাম্বাসেডরবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
সূত্র: বাসস