করোনাকালে শিক্ষার্থীদের নির্ভরতা ‘কিশোর বাতায়ন’
‘করোনার কারণে আপাত দৃষ্টিতে অনেক কিছু থেমে গেছে। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাইভেট পড়ারও সুযোগ নেই। সামনে পরীক্ষা। বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। শিক্ষার্থীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমন সময় সন্ধান মিললো কিশোর বাতায়নের,’ এমন সোজাসাপটা উত্তর মীমের।
মরিয়ম বিনতে নাহার মীম, ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঝাটিবুনিয়া জেআর গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষার্থী মীম করোনাকালে লেখাপড়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ‘কানেক্ট কিশোর বাতায়ন’ এ যুক্ত হয়েছেন।
মীম বলেন, আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক তার কাছেই ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল প্রথম শিক্ষামূলক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কিশোর বাতায়নের কথা জানতে পারি। ওই দিনই স্মার্টফোনের মাধ্যমে রেজিস্টেশন করি। এখন নিয়মিতই যুক্ত আছি। নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ ও আছে।
মীম জানায়, স্কুল থেকে সংক্ষিপ্ত সিলেবাস দিয়েছে। অনলাইনে ক্লাস করছি। দেশের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন। সত্যিকার অর্থেই মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছি। এখন স্কুল বন্ধ মনেই হয় না। সারাক্ষণ কিশোর বাতায়নের সাথেই আছি। আমি যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছি।’
শুধু মীমই নয়, দেশের প্রায় ৩৫ লাখ শিক্ষার্থী যুক্ত হয়েছে। এই করোনা মহামারীর সময়ে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষার পাশাপাশি কিশোর বাতায়নের প্রোগ্রামগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
কথা হয়, লালমনিরহাট জেলার দশম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফুল ইসলাম রাবুর সাথে। সে কালীগঞ্জ করিম উদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
করিম উদ্দিন বলেন, আমরা এক্ষেত্রে স্মার্টফোন ব্যবহার করি। এছাড়া, অনেক সময় কারো ল্যাপটপ বা স্মাট ফোনে কয়েকজন মিলে একত্রে ক্লাসগুলোতে অংশ নেই। মাঝে মাঝে লাইভ ক্লাসেও অংশ নেই।
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক খুর্শিদুজ্জামান আহমেদ বলেন, তাঁর স্কুলে ১শ’ শিক্ষার্থী এই কিশোর বাতায়নের সাথে যুক্ত। ২০২০ সালে এ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
শিক্ষার্থীরা সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে কিংবা ফেসবুক বা জুম কানেক্ট এর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয় । তিনি বলেন, একাডেমিক বিষয় ছাড়াও জীবন মানের উন্নয়নে করণীয়, বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের করণীয় বিষয়, করোনা কালীন প্রাসঙ্গিক বিষয়, সাইবার সর্তকতা প্রভৃতি বিষয়ে পাঠদান করা হয়। করোনাকালে এই পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের বিশেষ কাজে লাগছে।
পটুয়াখালী জেলার ঝাটিবুনিয়া জে আর গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন কিশোর বাতায়নের পটুয়াখালী জেলার একজন অ্যাম্বাসেডর। তিনি বলেন, পটুয়াখালী জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী ‘কানেক্ট কিশোর বাতায়ন’ এর সাথে যুক্ত। আমার গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিন-চার জনের এক একটি টিম করে দিয়েছি। যাদের স্মার্টফোন নেই তারাও যাতে দলবদ্ধভাবে এক জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই কাজ করতে পারে।
তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের ‘এমবি’ কিনে দেন। এতে তিনি বেশ আনন্দ পান। সরকারের চলমান এই শিক্ষা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করেন।
নাসির উদ্দিন বলেন, আমি ২০০৪ সালে ৫০ হাজার টাকা ধার করে একটি ল্যাপটপ কিনেছি। তখনো ভার্চুয়াল জগত সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিল না। ২০১৮ সালে দক্ষিণাঞ্চলে কিশোর বাতায়ন এর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বরিশাল অঞ্চলে ৩৭টি স্কুল এই বাতায়নে যুক্ত।
প্রধানমমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘রূপকল্প-২০২১’ তথা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে বিগত ১২ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শহর কিংবা গ্রামে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া লেগেছে। সারাদেশের নাগরিকগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। পাশাপাশি, তারা তথ্যপ্রযুক্তি-বান্ধব নাগরিক সেবা খুব সহজে, কম সময়ে এবং কম খরচে পাচ্ছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাস্তবায়নাধীন ও ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত এসপায়ার টু ইনোভেট-এটুআই প্রোগ্রাম ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। কিশোর বাতায়ন এরই একটি উদ্যোগ।
বাংলাভাষী কিশোর-কিশোরীরা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে পারবে।
এটুআইয়ে সংযুক্ত কর্মকর্তা প্রভাষক মো. সেলিম উদ্দিন জানান, বাতায়নে নিবন্ধিত কিশোর-কিশোরী এখন প্রায় ৩৫ লাখ। এটি একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম।
তিনি বলেন, কিশোর বাতায়ন তিনটি এরিয়া নিয়ে কাজ করে। শিক্ষা, জীবন দক্ষতা এবং কাউন্সেলিং (ক্যারিয়ার ও মনোসামাজিক)। এটুআই ২০১৮ সালে কিশোর বাতায়ন এর প্রাথমিক আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করে। পরে ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।
কিশোর বাতায়নের ওয়েবসাইট (http://www.konnect.edu.bd) এছাড়াও আছে ‘কিশোর বাতায়ন’ নামে ফেসবুক পেজ (https://www.facebook.com/konnect.edu.bd) ও গ্রুপ এবং ইউটিউবে রয়েছে ‘কিশোর বাতায়ন’ নামের চ্যানেল (https://www.youtube.com/channel/UCSdEG6ugXjX1DaOiZ8um6HA).
সেলিম উদ্দিন জানান, প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ‘কিশোর বাতায়ন সাইট’ এবং ১০ লাখেরও বেশি কিশোর-কিশোরী সোশ্যাল মিডিয়াতে ‘কিশোর বাতায়ন’ এর সাথে যুক্ত থাকে। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও যেন কিশোররা এতে যুক্ত হতে পারে সেজন্য কাজ করছে এই বাতায়ন।
করোনাকালীন যখন অনলাইন ক্লাস শুরু হলো, তখন কিশোর বাতায়নের শুরুর দিকের কার্যক্রমকে আরো আপগ্রেড করা হয়। সংসদ টেলিভিশনে যে ক্লাসগুলো সম্প্রচারিত হয় সেগুলো কিশোর বাতায়নের ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটে দেয়া শুরু হয়।
এছাড়াও, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ সেরা শিক্ষকদের মাধ্যমে এক হাজারেরও বেশি বিষয়ভিত্তিক ইন্টারেক্টিভ লাইভ ক্লাস সম্পন্ন করা হয়েছে।
২০২১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাস এর উপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বিশেষ ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে কিশোর বাতায়ন ফেসবুক পেইজে।
সেলিম উদ্দিন বলেন, জীবন দক্ষতা উন্নয়নে করোনাকালে বেশ কিছু সফট স্কিল নিয়ে কিশোর বাতায়নে ফেসবুক পেইজে সম্পন্ন হয়েছে অনলাইন কোর্স। এগুলোর মধ্যে কমিক্স তৈরির কোর্স আকিং বুকিং, সিনেমা বানাই ঘরে বসে, সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক কোর্স, ডিজিটাল সময়, কৈশোর, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট কোর্স এবং চলো গেম বানাই অন্যতম।
তিনি জানান, কিশোর বাতায়ন এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এদেশের শিক্ষার্থী ও কিশোর-কিশোরীদের। ‘Konnect the world, Friendship around the globe’ নামের প্রোগ্রামের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ১৩টি দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই কিশোর বাতায়ন।
কিশোর বাতায়ন নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে এটুআই কর্মকর্তা বলেন, কিশোর বাতায়নের জন্য নিজস্ব মোবাইল অ্যাপ তৈরিসহ নানা প্রচারণা চালানোর কাজ চলছে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে এক কোটি শিক্ষার্থীকে কিশোর বাতায়নে যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছে।
সূত্র: বাসস