সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে টিকটকের নেশায় বুদ কোমলমতি শিক্ষার্থীরা
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে করে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষার থেকে দূরে থাকায় প্রচুর অবসর সময় পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শহরের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা নিলেও মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা পার করছেন অবসর সময়। আর যারা অনলাইন ক্লাশে অংশগ্রহণ করছেন তারাও বাকি সময় বই থেকে দূরে রয়েছেন। আর এই অবসরে ইউটিউব, টিকটক কিংবা লাইকির মতো প্ল্যাটফর্মে আসক্ত হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। এসব অ্যাপসগুলো ব্যবহার করে দেশের কমলমতি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত হচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হচ্ছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে সমাজের নানা ধরনের অপকর্মে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, র্দীঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শারীরিক উপস্থিতির সুযোগ না পেয়ে অবসরে অলস সময় পার করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এতে করে সহপাঠী বা অন্যান্য বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা এবং যোগাযোগ কমে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ঝুঁকছে ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক ও লাইকি পাবজি ফ্রি-ফায়ার এর মতো প্ল্যাটফর্মে। একটি সমীক্ষা বলছে, করোনাকালীন সময়ে এই এসব প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন থেকে চারগুণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাদের ৮০ শতাংশই রয়েছে শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশে ভিডিও কন্টেন্ট স্ট্রিমিং সাইট বঙ্গবিডির অপারেসন্স বিষয়ক পরিচালক ফাইয়াজ তাহের দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দেশে মূলত তরুণ প্রজন্ম, যাদেরকে বলে মিলেনিয়াল তারাই এটি বেশ ব্যাবহার করছেন। মূলত হাসির জিনিস বানাতেই বেশি দেখা যায় তাদের।
তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির সময়ে টিকটক অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে।
টিকটক বা লাইকি তারকা হতে নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণী অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। সামাজিক জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
নোয়াখালীর বাসিন্দা মো. খোকন জানান, ৯ম শ্রেণিতে পড়ুয়া তার ছেলেটা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাড়ীতে অবস্থান করছেন। প্রথম দিকে একটু পড়াশোনা করলেও এখন সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পাবজি গেম এবং টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষণ টিকটকে ভিডিও বানাতে থাকে। নিষেধ করলেও বলে সারাক্ষণ বাসায় একা সময় কি করবো? স্কুল খুললে তো আর এইগুলো করবো না।
এদিকে, ভিডিও কন্টেন্ট নির্মাতা বাড়াতে টিকটক তার গ্রাহকদের রেফার বোনাস দিচ্ছে এতে করে অ্যাপটি ইনস্টলের প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে। একশ্রেণির যুবকেরা রেফার করে অন্যকে ও এর সুবিধা সম্পর্কে অবহিত করছে বিনিময় সেই রেফার বোনাস পাচ্ছে। একই সাথে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবে টিকটক লাইকির এই ভিডিওগুলো শেয়ার করে নগদ অর্থ উপার্জনেরও সুযোগ রয়েছে। সময় কাটানো, বিনোদন এবং অর্থ আয়ের পাশাপাশি এসব প্ল্যাটফর্মে চলছে ভার্চুয়াল খ্যাতি অর্জনের এক অশুভ প্রতিযোগিতা।
অন্যদিকে, টিকটক লাইকিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষকদেরও অবসর সময়ে বাসায় থেকে ভিডিও বানাতে দেখা যায়। শিক্ষকরা ড্যান্সসহ বিভিন্ন কন্টেন্ট ভিডিও বানিয়ে ফেসবুক ইউটিউবে শেয়ার দিচ্ছে। সম্প্রীতি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হাসিবুর রহমানের একটি টিকটক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেন। এতে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে।
এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে মতামত ব্যক্ত করেছেন। অপরাধ বিশ্লেষক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, অ্যাপকেন্দ্রিক নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। অনেকের মতে লাইকি-টিকটক অ্যাপ হচ্ছে যৌনতার যোগসূত্র। এই ধরনের সংস্কৃতির সঙ্গে শিশুরা যদি অভ্যস্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ অসুস্থভাবেই চলবে।
এ বিষয়ে সরকারের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটির সদস্য ও মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, এটা সত্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইউটিউব, টিকটক এসবে উপস্থিতি বেড়েছে। আমরাই শিক্ষার্থীদের স্মার্ট ডিভাইস দিয়েছি হয়তো ক্লাস করার জন্য। কিন্তু তাদের একটি অংশ সেখানে ইউটিউবে যাচ্ছে, ফেসবুকে যাচ্ছে, এমনকি পর্নো সাইটেও যাচ্ছে। এরজন্য অভিভাবকদের আরও যত্নশীল হতে হবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের মার্চে দেশে করোনা রোগীর শনাক্তের পর থেকে এর সংক্রমণ মোকাবেলায় ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত এখন পর্যন্ত বন্ধই আছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে।