ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা, অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষায় বিমুখ শিক্ষার্থীরা

ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে গাছে চড়েও অনলাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন অনেক শিক্ষার্থী
ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে গাছে চড়েও অনলাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন অনেক শিক্ষার্থী  © প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজের এক পরীক্ষার্থী গাছে চড়ে অনলাইন প্লাটফর্ম জুমে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। পরে নেটওয়ার্ক দুরাবস্থার কথা ফেসবুকে শেয়ার করেন ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত শিক্ষক ড. বেলাল হোসেন। তার স্ট্যাটাসে লেখেন, পরীক্ষা চলাকালীন হঠাৎ লক্ষ্য করি এক শিক্ষার্থী গাছে চড়ে ভাইভা দিচ্ছে! বোর্ডের সকলের দৃষ্টি তখন তার দিকে। বোর্ডের অন্য সদস্যদের মতো আমিও তখন শঙ্কিত!

স্ট্যাটাসের বিষয়ে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে আমাদের ইন্টারনেট বা মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনও গ্রামাঞ্চলে সেভাবে কাজ করে না। এরকম ভাইভা নিতে গিয়ে খুব মনোকষ্ট পেয়েছি। যার জন্য ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি দেয়া। শুধুমাত্র বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজের ওই শিক্ষার্থী নয়, করোনার এই মহামারীতে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। বিশেষ করে মফস্বল এলাকার চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ। ফলে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষায় বিমুখ হচ্ছেন এসব শিক্ষার্থী।

তথ্যমতে, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। ১৫ মাস পরও খুলতে পারেনি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলে মুখ থুবড়ে আছে শিক্ষার গতিপথ। শিক্ষার গতি কিছুটা সচল রাখতে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হলেও নানান প্রতিবন্ধকতা পিছু ছাড়ছে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে বর্তমান শিক্ষাকার্যক্রমের পুরোটাই হয়ে পড়েছে অনলাইনমুখী। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দেড় বছরেও গ্রামাঞ্চলে আসেনি উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধার সুফল। ফলে ইন্টারনেটের ধীরগতিসহ নানান সমস্যায় অনলাইন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ছে এসব শিক্ষার্থীরা৷ অনলাইন ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে৷ সেইসাথে বেড়েই চলেছে অনলাইন শিক্ষায় বৈষম্য ও ত্রুটি।

সম্প্রতি এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে , দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে অংশই নিতে পারেনি। অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গ্রামীণ শিক্ষার্থী। শহরাঞ্চলে পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধার ফলে শিক্ষার্থীরা চাইলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারলেও গ্রামীণ চিত্র বিপরীত।

তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত বছরের জুলাই থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আরও আগে থেকেই অনলাইনে শিক্ষাক্রম চালু করে। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফলাফল প্রকাশ কার্যক্রম চালাতে থাকে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি এমনকি সমাবর্তন অনুষ্ঠানও করেছে। কিন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারলেও পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় থেকে যায়।

এর কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ডিজিটাল সুবিধা পুরোপুরি নেই, যা দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও ঘরে বসে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাসেবা পেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ডিজিটাল সুবিধা দেয়ার কথা বলা হলেও আদতে তার বাস্তবায়ন হয়নি। উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নিরসনে যখন সমাধানের কথাবার্তা চলে, তখন শিক্ষকেরা কেবল একে অপরকে দোষারোপ করেই দায় সারার চেষ্টা করেন। কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী সেশনজট কমানোর জন্য অনলাইনে পরীক্ষা দিতে রাজি থাকলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে অধিকাংশের মত অনলাইন পরীক্ষার বিপক্ষে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর হাসান শান্ত বলেন, সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নত ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা পরিচালনা বেশ অবাস্তব চিন্তা। বহু শিক্ষার্থী এখন এমন স্থানে আছেন, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ খুব দুর্বল। সবাই যদি একই রকম সুযোগ-সুবিধা না পায়, তাহলে অনলাইন পরীক্ষা নিবে কিভাবে? নেটওয়ার্ক জটিলতায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আমরা অনলাইন ক্লাস করতে পারিনি।

রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. জাহিদ হাসান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। অনলাইন ক্লাসের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলে ঠিক মতো মোবাইলে কথা বলার জন্য নেটওয়ার্কই পাওয়া যায় না, ইন্টারনেট তো দূরের কথা। অনেকের স্মার্টফোন ও এলাকায় ইন্টারনেটের ভালো গতি থাকলেও ইন্টারনেট চালানোর ব্যয় অনেকেই বহন করতে পারেন না।

পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আল হাদিস সরদার বলেন, গ্রামে ইন্টারনেটের অবস্থা সবসময়ই খারাপ থাকে। যখন অনলাইন ক্লাস থাকে তখন বাসা দিয়ে বের হয়ে অনেক দূর গিয়ে করতে হয়। অনেক সময় ক্লাসে অংশগ্রহণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।

নীলফামারী থেকে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন,দীর্ঘ দেড়বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি,বিশেষত অনলাইন ক্লাসের সমস্যা। সেশনজট নিরসনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে,যা একটি শিক্ষার্থী বান্ধব উদ্যোগ। কিন্তু শহরের শিক্ষার্থীরা সহজেই অনলাইনে ক্লাস করতে পারলেও নেটওয়ার্ক জটিলতায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের বাইরে৷ এতো করে শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।

দিনাজপুর থেকে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থী ফিরোজ কবির সুমন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে গ্রামে চলে আসছি। কিন্তু ইন্টারনেটের ধীরগতির ফলে শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংযুক্ত থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে যেখানে চব্বিশ ঘন্টা ইলেকট্রিসিটি থাকাটাই একটা স্বপ্ন সেখানে ব্রডব্যান্ড থাকাটা দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। কখনও মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযুক্ত হলেও সেটা ভীষণ ধীরগতিসম্পন্ন। ঝড় বৃষ্টির কবলে পড়লে বিদ্যুৎ ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। মোবাইল চার্জ দেওয়াই অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, যতই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি না কেন, গ্রামাঞ্চলে এখন ও নেই উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা। সেইসাথে অনেক গ্রামে এখনো ঠিক মত বিদ্যুৎ পৌঁছায় নাই। এক্ষেত্রে শহর ও গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় বিরাট বৈষম্য নিরসনের সরকারের সুনজর জরুরি।

সিরাজগঞ্জ থেকে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো. সায়েম হাসান বলেন, করোনায় পরিবারে এমনিতেই আয় কমে গেছে। ইন্টারনেট কিনে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা, তাছাড়া ইন্টারনেটের ধীরগতির ফলে অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকের কথা ঠিকমতো শোনা ও বোঝা যায়না। তাই ইন্টারনেটে ধীরগতি রোধে দ্রুত পদক্ষেপ চাই৷

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যেহেতু করোনার প্রকোপে শিক্ষা কার্যক্রম এখন সম্পূর্ণ অনলাইনেই হচ্ছে এবং কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা অনিশ্চিত সেক্ষেত্রে শহুরে শিক্ষার্থীরা কিছুটা শিক্ষার আওতায় থাকলেও গ্রামীণ শিক্ষায় আছে বৈষম্য। গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা নানান প্রতিবন্ধকতায় বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষা থেকে৷ ফলে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহসহ শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে।

তিনি বলেন, শহুরে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সমানতালে গ্রামীণ শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষার আওতায় রাখতে শিক্ষা বিষয় নীতিনির্ধারকদের স্বল্পমেয়াদী, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে৷অনলাইন শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষার যে প্ল্যাটফর্ম বা ডিভাইস সেগুলো শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে দেওয়া যেতে পারে৷ মূলত শিক্ষা কার্যক্রমের যে পরিধি বর্তমানে রয়েছে এটিকে আরো বাড়াতে হবে৷ শিক্ষার পরিবেশ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিতে হবে৷

তিনি আরও বলেন, গ্রামাঞ্চলে নেটওয়ার্ক সমস্যা নতুন নয়৷ সেক্ষেত্রে গ্রামীণ জনপদে যত দ্রুত সম্ভব উচ্চগতিসম্পন্ন নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে হবে৷ এই মুহূর্তে যেহেতু আমরা গ্রামীণ পর্যায়কে ডিজিটালের আওতায় আনতে পারছিনা সেক্ষেত্রে এফএম রেডিও, টেলিভিশন, কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে জোর দিতে হবে। মূলত করোনাকালে গ্রামীণ শিক্ষাকে আরো কিভাবে সহজলভ্য করা যায় সেদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে৷ তা নাহলে শিক্ষায় এই বৈষম্য ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করবে এবং পরবর্তীতে একটি অংশ নানাবিধ সংকটের মুখোমুখি হবে৷


সর্বশেষ সংবাদ