বিদ্যুৎ খাতে ওভারক্যাপাসিটি, ক্ষতি আরও বাড়াবে করোনা: গবেষণা

  © ফাইল ফটো

প্রয়োজনের অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (ওভারক্যাপাসিটি) তৈরি হওয়ায় বিদ্যুৎখাত ইতিমধ্যেই প্রতিবছর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারী এই ক্ষতিকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলবে। এর মধ্যে আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র যোগ হলে দীর্ঘমেয়াদী ওভারক্যাপাসিটিতে বিপুল আর্থিক সংকটে পড়বে বিদ্যুৎখাত।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যাণ্ড ফাইন্যান্সিয়াল এনালিসিস (আইইইএফএ)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ আশঙ্কা করা হয়েছে। সোমবার গবেষনাপ্রতিবেদনটি প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাস মহামারির আগেই দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছিল (২০১৮-২০১৯ অর্থবছর)। মহামারির কারণে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আরও কমে গেছে। এতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) একদিকে রাজস্ব আয় হারাচ্ছে, অন্যদিকে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করছে।

মহামারীর আগেই এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের জন্য সরকার ৯ হাজার কোটি টাকা (১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিয়েছে। লস কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়েছে। এরইমধ্যে কয়লা ও এলএনজি-ভিত্তিক নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এতে দীর্ঘমেয়াদী ওভারক্যাপাসিটির আবর্তে পড়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে দেশ।

গবেষণার প্রধান বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস বলেন, ‘অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব আমলে নিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস আমরা করেছি, সে অনুসারে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি থাকবে।’

বিউবোর ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিদ্যুৎখাতের সর্বমোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৯ হাজার ৬৩০ মেগাওয়াট। তবে গতকাল সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে প্রকৃত সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল মাত্র ১০ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি।

কোভিড-১৯-এর প্রভাব বলতে গবেষণায় বোঝানো হয়েছে, বিদ্যুতের চাহিদা দীর্ঘমেয়াদে ধারণার চেয়েও অনেক কমে যাবে। কারণ মহামারীর প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে বিদ্যুতের চাহিদা দুটোই কমবে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারীর প্রভাবে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। আর বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

সাইমন নিকোলাসের মতে, তুলনামূলক সস্তা নিজস্ব গ্যাস থেকে সরে এসে আমদানীকৃত কয়লা ও এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদী ওভারক্যাপাসিটিতে বাংলাদেশকে আটকে দেবে, যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়বে বিদ্যুতের দাম।

২০০৯-১০ থেকে গত ১১ বছরে খুচরা পর্যায়ে ১০ দফায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯৮ শতাংশ। সর্বশেষ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ৫.৩ শতাংশ বাড়ানো হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বৃহদাকার বিদুৎকেন্দ্র দিন দিন গলার কাটা হয়ে উঠছে। কারণ এসব দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আশানুরুপ বাড়ছে না। যেমন, মিশর সম্প্রতি ৬.৬ গিগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অনির্দিষ্টকারের জন্য স্থগিত করেছে, এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবছে।

কয়লা বিদ্যুতের ওপর ইন্দোনেশিয়ার অতিমাত্রার নির্ভরতায় তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি গবেষণায় তুলে ধরেন সহগবেষক সারা জেন আহমেদ। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিদ্যুৎ কোম্পানি পিএলএনকে প্রায় ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ভর্তুকি দিয়েছে দেশটির সরকার। দেশটিতে ২০১৯ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির একটি অতিরঞ্জিত ধারণা করা হয়।

এই বিভ্রান্তিকর ধারণার ভিত্তিতে সেখানে প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এর ফলে বিদ্যুতের ওভারক্যাপাসিটি সৃষ্টি হয় এবং প্রতিবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ভর্তুকি ও বিদ্যুতের দাম।

পটুয়াখালীর পায়রায় চালু হওয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশেও ইন্দোনেশিয়ান অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। গত ১৪ মে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। কেন্দ্রটির অর্ধেকের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় বাউবোকে প্রতিমাসে অতিরিক্ত ১৬০ কোটি টাকা (১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এতে বাউবো আরও আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে।

গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাত যদি ইন্দোনেশিয়ার মতো আর্থিক বিপর্যয়ে পড়তে না চায়, তবে ইন্দোনেশিয়ান অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বিদ্যুৎখাতকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশের উচিত কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, যেখানে ক্যাপাসিটি চার্জ থাকবে না। দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য উপযোগী জমির পরিমাণ নিয়ে এর আগে যে ধারণা করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে উপযোগী জমির পরিমাণ তা থেকে বেশি।

এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জমির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি ও দাম বাড়ানোর আবর্ত থেকে বের হতে চাইলে এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

গবেষকদের মতে, মহামারির প্রভাবে যেমন দেশের কয়লা বিদ্যুৎপ্রকল্পগুলোতে ধীর গতি এসেছে, তেমনি এটি বিদ্যুৎখাতের পরিকল্পনা নতুন করে ঢেলে সাজানোর সুযোগ করে দিয়েছে। ভর্তুকি কমিয়ে এনে বিদ্যুতের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে গেলে নতুন নীতিমালা প্রয়োজন, যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল শক্তি হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে বিবেচনায় আনতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ