আস্থার সংকটে ৪৭ হাজার আমানতকারী ছাড়লেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান
দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা একেবারে তলানিতে, যা কোনোভাবেই ফেরানো যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ এখন আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আগের মতো আমানত রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। কেননা, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম ঘটেই চলেছে এসব প্রতিষ্ঠানে। তাই আমানতকারীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে ২০২২ সাল থেকেই। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪৭ হাজার আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন।
অবশ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমানত সংগ্রহের চেয়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য হলো, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়মের কারণে বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখতে সাহস পান না।
প্রায় প্রতি মাসেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর সংখ্যা কমছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাযথ তদারকিও হচ্ছে না। তবে গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের বিকল্প নেই।
এক হিসেবে দেখা যায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত মার্চ শেষে আমানতকারী ছিল মোট ৪২৭৩৪১ জন, জুন শেষে তা দাঁড়ায় ৩৭৯৭৩৭ জনে। সরকারি বিল-বন্ডে সুদহার বেশি বলে আমানতকারীরা সেদিকেই ঝুকছেন।
আর্থিক খাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, জুন প্রান্তিকে আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে। আসলে এই সময়ে সরকারের বিল-বন্ডের সুদহার বেশি থাকায় আমানতকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের আমানত তুলে সেখানে রেখেছে। মানুষ তো টাকা রাখে লাভের জন্য। যেখানে বেশি লাভ পাবে সেখানেই তো তারা যাবে।
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকে মানুয়ের আস্থা হারিয়ে যাওয়ার কারণে আমানত তুলে নিচ্ছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে গোলাম সরওয়ার ভুঁইয়া বলেন, নানা কারণেই কিছু আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে মানুষের আস্থা বাড়ানো যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৪১ জন। আর তিন মাস পর অর্থাৎ জুনের শেষ দিকে আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭ জনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই হিসাবে অনুযায়ী তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে ৪৭ হাজার ৬০৪ জন ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ৩ হাজার ৮৮০ জন। এর আগে ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা কমেছিল ২৫ হাজার ৭৮২ জন। এর আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এ সংখ্যা কমেছিল ১৮ হাজার ৪৯৩ জন। এছাড়া ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এ সংখ্যা কমেছিল ৩৫ হাজার ৫ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জুন প্রান্তিকে মাত্র ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ আমানত বেড়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। অবার, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৮ হাজার ১১৩ কোটি ৯ লাখ টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ৭৪ হাজার ৫২৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর তিন মাস পর (এপ্রিল-জুন) আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
সবেচেয়ে বেশি আমানত কমেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এ বিভাগে আমানত ছিল ২১ হাজার ৭৩৫ কোটি ২ লাখ টাকা। আর জুন শেষে এ বিভাগের আমানত দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। আমানত কমার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা বিভাগ। এ বিভাগে জুন শেষে আমানত দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৮ লাখ টাকা। আর মার্চ শেষে এ বিভাগে আমানত ছিল ৩ হাজার ৫৪০ কোটি ৭ লাখ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খুলনা বিভাগে আমানত কমেছে ৬৮৯ কোটি টাকা।
অপর দিকে ঢাকা বিভাগে আমানত বেড়েছে ২ দশমিক২০২ শতাংশ, রাজশাহীতে ১ দশমিক ২৭ শতাংশ, সিলেটে ১ দশমিক ১২ শতাংশ এবং রংপুর বিভাগে বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।