হোয়াটসঅ্যাপে হঠাৎ লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব পেলে যা করবেন
হোয়াটসঅ্যাপ হচ্ছে তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। দিন দিন এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। এখন অফিশিয়াল অনেক কাজে ব্যবহৃত হয় হোয়াটসঅ্যাপ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই অপরিচিত নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন। হোয়াটসঅ্যাপে হঠাৎ লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব পেলে যা করবেন।
গত অক্টোবরে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে আসা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে চাকরির প্রস্তাব পান তিনি। ওই মেসেজে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে দৈনিক অন্তত পাঁচশো টাকা আয় হবে, এমন একটি অনলাইন পার্ট টাইম চাকরি করতে তিনি আগ্রহী কিনা?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা মিস সুলতানা সেসময় বিভিন্ন জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিলেন আর নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করতেন। স্বাভাবিকভাবেই ঘরে বসে অনলাইনে কাজ করার প্রস্তাবে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। এরপরই তাকে একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয় এবং সেখানে তাকে কাজ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়। এরপরই সুলতানা তার ফোন নম্বর ও মোবাইলে টাকা লেনদেনের একটি অ্যাপের অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে সেই সাইটে লগ-ইন করেন। লগ-ইন করার সময় তার টাকা লেনদেনের মোবাইল অ্যাপের প্রোফাইলের পিন নম্বরও ওই ওয়েবসাইটে প্রবেশ করান তিনি।
মূলত, অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার একটি ট্রেডিং ওয়েবসাইটে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির কাজের প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে, যেখানে পণ্য বিক্রি করতে পারলে তিনি কমিশন পাবেন বলে জানানো হয়।
সুলতানা বলেন, আমাজন ও দারাজের মত একটি পণ্য কেনাবেচার ওয়েবসাইটে আমাকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়া হয়। আর কাজ শুরু করার আগেই আমার অ্যাকাউন্টে একটা ছোট অ্যামাউন্ট পাঠানো হয় উপহার হিসেবে। শুরুতে ৫০০ টাকার একটি পণ্য কিনতে বলা হয়। অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা দিয়ে সেটি কেনার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায় এবং আমাকে কমিশনের একটি অংশও পাঠানো হয়। আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাওয়ার মেসেজও আসে।
এরপরের ধাপে তাকে এক হাজার টাকার একটি পণ্য কিনতে বলা হয়, এভাবে ধাপে ধাপে পণ্য কেনার জন্য তার অর্থের পরিমান বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সোহেলি সুলতানার কিছুটা সন্দেহ হয় পুরো বিষয়টি নিয়ে। তবে পরের ধাপে তিনি বিনিয়োগ করতে অপারগতা জানালে যখন প্রতিষ্ঠান তার আংশিক টাকা দিয়ে দেবে বলে জানায়, তখন কিছুটা আশ্বস্ত হন তিনি।
সুলতানা বলেন, পরের টাস্কে যখন আমাকে ২৭ হাজার টাকার একটি ঘড়ি কিনতে বলা হয়, আমি জানাই যে এত টাকা দেয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। তখন তারা জানায় যে আমার হয়ে এই কাজটির টাকার একটি অংশ তারাই দিয়ে দেবে। তখন তারা কিছু টাকা দেয় আর আমি আংশিক টাকা দেই ও ঘড়িটি কিনে নেই। তাদের ওয়েবসাইটে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটি বিক্রিও করি। এরপর শেষ টাস্ক দেয়া হয় ৮৫ হাজার টাকার একটি কার্পেট কিনে বিক্রি করার। এই ৮৫ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ হাজার তিনি দেবেন এবং ৩৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। এই টাস্কটি সম্পন্ন করতে পারলেই মিস সুলতানা তার মূলধন ও আয়সহ পুরো টাকাটা তুলে বের হয়ে আসতে পারবেন বলে জানানো হয় তাকে।
সে সময় ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়বেসাইটে থাকা সোহেলি সুলতানার অ্যাকাউন্টে প্রায় দুই লাখ টাকা জমা রয়েছে - এমনটি দেখা যাচ্ছিল বলে জানান তিনি। এই পর্যায়ে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে টাস্ক সম্পন্ন করার পরও যখন তাকে ৮৭ হাজার টাকার আরেকটি টাস্ক দেয়া হয় ও জানানো হয় যে সেটি সম্পন্ন করতে পারলে তিনি তার টাকা তুলতে পারবেন, তখন তিনি নিশ্চিত হন যে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এরপর তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরনাপন্ন হন। তবে তারা তাকে উপদেশ দেয় তাদের (প্রতারক চক্র) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে যেন তারা বুঝতে না পারে যে মিস সুলতানার তাদের বিষয়ে সন্দেহ হয়েছে।
পুলিশের পরামর্শ অনুযায়ী সুলতানা প্রতারক চক্রের সঙ্গে ২৮ থেকে ৩০ অক্টোবর দুপুর পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে যান। এর কয়েকদিন পর পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয় যে ওই প্রতারক চক্রের কয়েকজন সদস্যকে আটক করা হয়েছে। ওই ঘটনায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে ৭০ হাজার টাকা হারায় সে।
এরকম চাকরির ফাঁদে পড়া এক ভুক্তভোগী আইনের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাদের করা মামলার ভিত্তিতে গত কয়েকমাসে দেশের একাধিক স্থান থেকে এই ধরনের আলাদা আলাদা প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকা বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে এভাবে জালিয়াতি করার চক্রগুলো মানুষের দুর্বল পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। শিক্ষিত চাকরি প্রত্যাশী, আর্থিক অনটনে থাকা মানুষ এ ধরনের অনলাইন স্ক্যামের অপেক্ষাকৃত সহজ লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় তাদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপে যেভাবে স্ক্রিন শেয়ার করবেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বিএম মাইনুল হোসেন বলেন, কোন ধরনের মানুষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে, তা অনলাইন প্রতারকরা ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর মাধ্যমে ঠিক করে।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পেলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানের অফিসের ঠিকানা থাকলে সেখানে যাওয়া, ওয়েবসাইট থাকলে সেটি যাচাই করা, যে ধরনের কাজের কথা তারা বলছে সেই বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করার মত কাজগুলো করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি পরিচিত অন্যান্য মানুষের সাথেও কাজ নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
যদি কারো পক্ষে এসব বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়া সম্ভব না হয় তাহলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করার বিষয়ে জোর দেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বি এম মাইনুল হোসেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা