প্রোগ্রামিং: বুদ্ধির লড়াইয়ে সেরাদের সেরা ওরা
তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রোগামিং নিয়ে প্রতি বছর বিশেষভাবে আয়োজিত হয় প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ অলিম্পিয়াড ‘ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্টে’র (আইসিপিসি)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ এ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ইন্টারনেটযুক্ত কম্পিউটারে টানা ছয় ঘণ্টাব্যাপী প্রোগ্রামিং সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন বা সমস্যার সমাধান করতে হয় প্রতিযোগীদের। চূড়ান্ত আসর বা ফাইনালে পরীক্ষাটি পরিচালনা করে আইসিপিসির বিচারক পর্ষদ। প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি সমস্যার সমাধান করা দলকে ওয়ার্ল্ড ফাইনাল বিজয়ী ঘোষণা করেন বিচারকরা।
আইসিপিসি’র এবারের ৪৬তম আসর আয়োজিত হবে পিরামিড আর মমির দেশ মিশরে। সে আয়োজনকে ঘিরে শুরু হয়েছে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা। ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট ‘র (আইসিপিসি) এশিয়াধীন ঢাকা অঞ্চল পর্বের প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল বেসরকারি গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। এশিয়াধীন ঢাকা অঞ্চল পর্বের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির ‘ডিইউ ক্রোনোস’ টিম প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং একই প্রতিষ্ঠানের আরেক টিম ‘ডিইউ নট রেডি ইয়েট’ দ্বিতীয় ও ‘বুয়েট সম্মোহিত’ তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।
গত শনিবার (১১ মার্চ) ৯২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬২টি টিমের অংশগ্রহণে এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্থায়ী ক্যাম্পাসে। এর আগে প্রতিযোগিতার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ১২৮ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোট ১৬৪৮টি টিম অংশ নেয়। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান অর্জনকারী অন্য টিমগুলো হলো- তৃতীয় হিসেবে বিশেষ পুরষ্কার আইওআই ১, ব্রাকইউ ক্রোস, আইইউটি স্লো ফ্রুরিয়ার ট্রান্সফর্ম, সাস্ট বঙ্কক্লাউড, বুয়েট হ্যালোবাইট প্রভৃতি। শনিবার প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ী এসব টিমের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস ঢাকা: বাংলাদেশের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মেলবন্ধন কতদূর?
আঞ্চলিক আসরের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এবারের আয়োজনে কেমন ছিল সেরাদের সেরা হওয়ার এই লড়াই-দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে গল্পচ্ছলে সে কথাই জানালেন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব হাসান, ইয়ামিন কায়সার ও ভোলানাথ দাস। বিজয়ী তিনজনের মধ্যে সাকিব চতুর্থ বর্ষ এবং ইয়ামিন ও ভোলানাথ দাস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
ইয়ামিন কায়সার জানান, গ্রিন ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে আইসিপিসির রেজিস্ট্রেশন শুরু হওয়ার এক মাস আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর মাসে আমাদের টিমটি গঠন হয়। তখন থেকেই ভালো কিছু করার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু, সেটা যে এত ভালো হবে, ভাবিনি। আর আরেক প্রতিযোগী ইয়ামিন বলছেন, প্রতিযোগিতার শুরুর দিকে পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমাদের সবার সম্মিলিত চেষ্টায় পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমরা প্রতি সপ্তাহেই একটি প্রোগ্রামিংয়ে অংশ নিয়ে থাকি। এভাবেই আমরা এবারের আইসিপিসি প্রতিযোগিতায় ভালো অবস্থান করতে পেরেছি।
আঞ্চলিক আসরে বিজয়ী দলের আরেক শিক্ষার্থী ভোলানাথ দাস বলেন, দুই-আড়াই মাস আগে যখন টিমটি গঠন করি, তখন থেকেই একটা স্বপ্ন ছিল। প্রত্যাশা ছিল, প্রথম ১০টিমের মধ্যে থাকব বা থাকা উচিত। কিন্তু, সেটা যে প্রথম হবে, সেটা কল্পনায় ছিল না। ভোলানাথ বলেন, বিভাগের উদ্যোগে সপ্তাহে দুই দিন (শনিবার ও সোমবার) পাঁচ ঘণ্টা করে প্র্যাকটিস করেছি। এছাড়াও ছুটির দিন শুক্রবার আলাদা করে সময় দেওয়া হয়েছে। মূলত, এভাবেই প্রথম স্থান অর্জন করেছি।
আরও পড়ুন: প্রোগ্রামিং বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন এমআইটি, অঞ্চলের সেরাতেও নেই বাংলাদেশ
ঢাকা অঞ্চল পর্বের প্রতিযোগিতার এবারের আসরে দ্বিতীয় হওয়া ঢাবি থেকে অংশ নেওয়া ‘ডিইউ নট রেডি ইয়েট’র প্রতিযোগী মহিদুল হক মৃদুল বলছেন, আমরা প্রথম বর্ষ থেকেই প্রোগামিং নিয়ে কাজ করছিলাম। আসলে প্রোগামিংটাকে আমি দেখি মজার জায়গা থেকে। এখন আমরা মোটামুটি ভালো একটি অবস্থানে রয়েছি। তবে, সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, আমরা টানা তিনবার রিজিয়ন চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, যা এর আগে হয়নি। আমাদের টিমের সবাই ঢাবির সিএসইতে পড়ে; আমাদের টিম কম্বিনেশন ভালো ছিল এবং আমাদের মধ্যে একটি ভালো বোঝাপড়ার কারণেই আমরা এতো দূর আসতে পেরেছি।
আগামী বিশ্ব আসরে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে এ শিক্ষার্থী বলছেন, আমরা একটি টিম হিসেবে চেষ্টা করবো ওয়ার্ল্ড ফাইনালে যাওয়ার জন্য; আমাদের টিম থেকে এখনো কারো সে সুযোগ হয়নি। আশা করছি, সামনে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রোগামিং করাকে একটি ‘জব’ হিসেবে দেখা হয়; সমস্যার সমাধানে প্রোগামিং করার চিন্তাটি এখনো এখানে প্রতিষ্ঠা পায়নি। সেজন্য, কাজ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলছেন, প্রোগামিংকেও দেখতে হবে বাস্তব সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে জীবনকে সহজ করার জায়গা থেকে, একটি মজার জায়গা থেকে।
ঢাকা অঞ্চল পর্বের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দল ‘বুয়েট সম্মোহিত’র ইফতেখার হাকিম কাউসার বলছেন, দল হিসেবে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। নিজেদের মধ্যে আরও ভালো বোঝাপড়া করতে পারলে আরও ভালো কিছু করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। আর প্রোগামিং ভালো লাগে বলেই এসব আসর কিংবা এ ধরনের কাজগুলো করছেন এই শিক্ষার্থী ও তার দল; তার প্রত্যাশা সমানের আসরে আরও ভালো কিছু করবে তার দল।
আরও পড়ুন: ঢাকায় বসছে এবারের প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বকাপ, উদ্বোধন মঙ্গলবার
আইসিপিসির প্রতিযোগিতাটি প্রতি বছর দু’টি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। ১ম পর্বে বিশ্বের ৮টি অঞ্চল থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিজয়ীরা চূড়ান্ত (ওয়ার্ল্ড ফাইনাল) পর্বে অংশ নেয়। আইসিপিসি, ঢাকা বিশ্বের ৮টি অঞ্চলের মধ্যে এশিয়া-পশ্চিম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের ৮টি অঞ্চল থেকে আঞ্চলিক পর্বে বিজয়ী দলগুলো গতবছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় আইসিপিসি এর চূড়ান্ত পর্বে (৪৫তম আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালস্ ঢাকা) অংশ নিয়েছিল। চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে বিজয়ী দলকে দেয়া হয় চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, সনদ এবং ১৫ হাজার ডলার। এছাড়াও, অঞ্চলভিত্তিক সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ১২টি দলকে বিভিন্ন বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া চারটি দলকে স্বর্ণপদক এবং পঞ্চম থেকে অষ্টম স্থানের জন্য রৌপ্য এবং নবম থেকে দ্বাদশ স্থানের জন্য থাকে ব্রোঞ্জ পদক।
প্রসঙ্গত, গত ৪৫তম আসরে স্বাগতিক বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দল। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (এনএসইউ), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। এবার ৭০টি দেশের ১৩৭টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হলো আইসিপিসি। আইসিপিসি আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের বেলর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে আইসিপিসি ফাউন্ডেশন।
আরও পড়ুন: আইসিপিসি এশিয়া ঢাকা আঞ্চলিক পর্বের আয়োজক গ্রিন ইউনিভার্সিটি
গতবছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এ ইভেন্টের আয়োজন করছে এবং চীন, জাপান এবং থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশ এশিয়ার মাত্র চতুর্থ দেশ যারা এ ইভেন্টের আয়োজক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
আইসিপিসির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭০ সাল থেকে। যদিও ১৯৭৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ আয়োজনের দায়িত্বে ছিল কম্পিউটারের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অন্যতম বৃহৎ ও পুরোনো প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্পিউটিং মেশিনারি (এসিএম)।