রাজু ভাস্কর্যের রাজু ২৮ বছরেও এলো না
- ছিদ্দিক ফারুক, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২০, ০৮:৫৮ PM , আপডেট: ০৯ জুন ২০২০, ০৮:১৫ PM
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান চোখে পড়ার মত। এ কারণে অনেকেই বলে থাকেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বাংলাদেশ। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ নানা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্মিত হয়েছে অগণিত ভাস্কর্য। এগুলোরই একটি ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু’।
১৯৯৭ সালের শেষভাগে এর নির্মাণকাজ শেষে হলেও পথচারী তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও এর ইতিহাস জানেন না। অনেকে আবার এটাকে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বলে গুলিয়ে ফেলেন। আত্মভোলা, ইতিহাস-বিস্মৃত এ জাতির কাছে অবশ্য এটা অস্বাভাবিক নয়। কী লাভ হয়েছে রাজুর আত্মদানে? কিংবা প্রতিবন্ধকতার পাহাড় ঠেলে, কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে এই ভাস্কর্য নির্মাণে?
হয়তো এ কারণেই রাজুর বড় ভাই ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পদার্থবিদ মুনীম হোসেন আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘রাজুর আত্মত্যাগ যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তা যেন আরও প্রকট হয়েছে। এখানে বলতেই হয়, সন্ত্রাস মানে শুধু অস্ত্র–সন্ত্রাস নয়, এর মধ্যে রয়েছে আমাদের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিও। আমাদের দেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছে, এগোচ্ছে। কিন্তু ওর যে স্বপ্ন ছিল, তার ধারেকাছেও আমরা যেতে পারিনি। ২৮ বছর তো হয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে আরও অনেক রাজু তৈরি হওয়ার কথা ছিল, হয়নি। এসব ভাবলে কিছুটা হতাশ হই। একরাশ হতাশা নিয়েই ভাইয়ের আত্মত্যাগ স্মরণ করি।’
পুরো নাম মঈন হোসেন রাজু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। সমাজটাকে বদলে দেয়ার স্বপ্ন ছিল রাজুর। কিছুটা একরোখা ও জেদি হলেও আশ্চর্যরকম সরল রাজু ছিল স্বপ্নবানদের একজন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, ছিলেন কেন্দ্রিয় নেতাও।
শুক্রবার ছিল সেদিন। রমজান মাস। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ। রাজুসহ কয়েকজন ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং নিয়ে কথা বলছিল সবুজ চত্বরে। হঠাৎই বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। টিএসসিতে জিম্মি হয়ে পড়ে শত শত সাধারণ শিক্ষার্থী। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাদের ভূমিকা ছিল স্রেফ দর্শকের।
পুলিশের এই ভূমিকার প্রতিবাদেই প্রথম সোচ্চার হয় রাজু। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে অস্ত্রবাজদের গ্রেপ্তার করার আহবান জানান তিনি। ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে পুলিশ ভূমিকা পালন করে বটে, কিন্তু সেটা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক কর্মীদের প্রটেকশন দেওয়ার কাজে। অন্যদিকে বিপরীতে থাকা নেতাদের দিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে; যা ক্রমেই বিস্তৃত হয় পুরো টিএসসিতে। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
এরই প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল বের করে রাজুরা। মিছিলে শরিক হন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যভুক্ত’ বাম ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। টিএসসির সড়কদ্বীপ প্রদক্ষিণ করার সময় ডাসের সামনে ‘অস্ত্র শিক্ষা একসাথে চলবে না’, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ এক হও’- এ স্লোগান যখন উচ্চারণ হচ্ছিল, তখন হাকিম চত্বরের সামনে থেকে একঝাঁক বুলেট মিছিল লক্ষ্য করে ছুটে আসে। এর একটি গুলি কপালে লাগে তার।
স্লোগান মুখে নিয়েই সে লুটিয়ে পড়ে টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে সড়ক দ্বীপের পাশের রাস্তায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রাণভয়ে দ্বিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। তখন সময় সন্ধ্যা সোয়া ছয়টা। রাজুর রক্তমাখা দেহ নিয়ে তার বন্ধুরা রওনা হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে, ৩২ নং ওয়ার্ডে। রাজুর দেহ থেকে অবিরাম টপ টপ করে রক্ত ঝরতে থাকে। তার শার্ট রক্তে ভিজে যায়। রক্তাক্ত রাজুকে এক ঝলক দেখেই কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, রক্ত চাই, অনেক রক্ত। মুহূর্তে রাজুর সহযোদ্ধারা দল বেঁধে রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়ার শামিল হন।
কিন্তু রাজুকে আর রক্ত দিতে হয়নি। সবার সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে, কাউকে কিছু করার সুযোগ না দিয়ে রাজু চিরতরে চলে যায়। একটা দুঃসহ বেদনা আচ্ছন্ন করে। রাজুর পরিবারের সদস্য– শোকবিহ্বল বড় ভাই রানা, শোকাতুর বোন রুমা আর গভীর যন্ত্রণাহত মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলে তার বন্ধুরা। সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতির বুলেটে এভাবেই শেষ হয়ে যায় একটি অনন্ত সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার প্রকৃত পরিবেশ ফিরে আসুক। এমন একটি পবিত্র আকাঙ্ক্ষার মঈন হোসেন রাজু জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
গানরত রাজুর কাঁধে যে ব্যাগটি ছিল সেই ব্যাগে ছিল নোটখাতায় নিজ হাতে টুকে রাখা জীবনানন্দের কবিতা এবং রং করার ব্রাশ ও হকিয়ার। সেই দিনের শহীদ রাজুর রক্তমাখা শার্ট ও ব্যাগ এখনো সংরক্ষিত রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সংগ্রহশালায়।
মৃত্যুর আগে মাকে বলতেন, ‘দেখো, একদিন আমার পরিচয়ে তুমি পরিচিত হবে।’ সেটিই হয়েছে আজ রাজুর নামেই তার মাকে চিনতে পারে সকলে। আজ রাজু বেঁচে নেই। কিন্তু রয়েছে তার রেখে যাওয়া চেতনা। যে চেতনা এখনো লক্ষ কোটি ছাত্রজনতাকে শিক্ষা দেয় প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ কিভাবে প্রজ্জ্বলিত করতে হয়। সে চেতনার সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সড়ক মোড়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য’। যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ষোল কোটি মানুষকে শিক্ষা দেয় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।
রাজুর মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় আরও একবার নতুন করে জাগ্রত হয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তৎকালীন ছাত্র-জনতা।
রাজুর মৃত্যুতে নাগরিক কবি শামসুর রাহমান রচনা করেন তার অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘পুরাণের পাখি’। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে মইন হোসেন রাজুর এই আত্মত্যাগকে আরও মহিমান্বিত করেন। কবির ভাষায়-
রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও
তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই প্রয়োজন।
দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে।
টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া
তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল
পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে
হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,
মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক
উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,
তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার,
মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা
তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,
তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের
সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,
হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে
সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে গর্ত।
রাজুর স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্যই হচ্ছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য, সংক্ষেপে একে শিক্ষার্থীরা জানে ‘রাজু ভাস্কর্য’ বলে। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী এবং তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন গোপাল পাল। এর অর্থায়নে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান ও মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল।
বারবার বহু বাধা বিপত্তি এসেছে এই ভাস্কর্যের নির্মাণে, তবে শেষমেষ রাজুর মতোই হার মানেনি রাজু ভাস্কর্যও। ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন উপাচার্য এ.কে. আজাদের হাতে এর উদ্বোধন হয়। এর সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে ছাত্র ইউনিয়ন।
ভাস্কর্যে ৮ জনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যাদের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে তারা হলেন- মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।