টিএসসির স্বপন মামা, মধুর ক্যান্টিনের রুবেলদের আর চলছে না
‘অন্ধকার মানুষ’ শিরোনামে গেয়ে গেছেন, ‘কেউ জানো না- আমি কি খুঁজি/কেউ বোঝনা- আমার স্বপ্ন; অন্ধকারে থেকেও আমি/অন্তহীন আঁধার খুঁজি।’ আইয়ুব বাচ্চু কীসের ভিত্তিতে আঁধার খুঁজেছেন তা হয়ত জানা যায়নি; কিন্তু ওদের তো আঁধার চাইতে হয় না। আলোর ঝলকানিতে দিন-রাত কাজ করলেও আঁধারই যে ওদের নিত্যসঙ্গী। আর আঁধারকে ‘ঘুটঘুটে অন্ধকার’ বানিয়ে দিল মরণব্যাধি মহামারী কোভিড-১৯।
গোটা বিশ্বই এখন করোনাভাইরাস কাপাচ্ছে। যার প্রভাবে গোটা সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত বন্ধ প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও। একই কারণে বন্ধ টিএসসি, মধুর রেস্তোরাঁ কিংবা থোকায় থোকায় গড়ে ওঠা ভাসমান চায়ের দোকানগুলোও। এমন ক্রান্তিকালে কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন এসব দোকানিরা? প্রিয় মধুর রেস্তোরা কিংবা হল ক্যান্টিনের ছেলেগুলোই বা কেমন আছে? এ নিয়ে আগ্রহ অনেকের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসের দোকানিরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যের মতই। তারাও যেন শিক্ষার্থীদের ভাই-চাচা-মামা হয়ে মিলেমিশে থাকেন। খোঁজে জানা গেছে, এসব মানুষের অধিকাংশের আয়-রোজগারের উৎসই একমাত্র দোকান কিংবা ক্যান্টিন থেকে মাস শেষে পাওয়া টাকা। আর সেটাই এখন না থাকায় কোনোমতে খেয়ে-পড়ে বাঁচতে হচ্ছে তাদের। আপাতত কোনোভাবে চালিয়ে নিলেও চোখ বুজে আসছে ভবিষ্যতের চিন্তায়। কাটাচ্ছেনও দুঃসময়।
চিন্তায় পড়া এমনই একজন পরিচিত মুখ স্বপন। দশকের পর দশক শিক্ষার্থীরা ঢাবি ক্যাম্পাসে এসেছেন, পড়া শেষে চলেও গেছেন; কিন্তু স্বপনের আর যাওয়া হয়নি। গত ৪০ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে চা বিক্রি করছেন এই স্বপন। যার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন প্রিয় ‘স্বপন মামা’ ডাক। যার হাতে বানানো চা খেয়েই সকাল শুরু হয় অনেক শিক্ষার্থীর; অনেকে ঘুমোতেও যায় এই চা খেয়ে। লকডাউন জীবনে কেমন আছেন সেই স্বপন মামা?
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, তিন সন্তান, স্ত্রী এবং এক নাতি নিয়ে মোটামুটি সুখেই আছি। কিন্তু বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটাব, সেটা নিয়েই শঙ্কায় আছি। স্বপন মামা বললেন, আমার একমাত্র সম্বল টিএসসির চায়ের দোকান। ক্যাম্পাস এবং পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় সেই দোকানও খোলা যাচ্ছে না। স্বভাবতই চিন্তা তো হবেই।
কোন ব্যক্তি, সংগঠন সাহায্য সহযোগিতা করছে কিনা জানতে চাইলে স্বপন বলেন, আল্লাহর রহমতে অনেকেই সাহায্য করছেন। যা দিয়ে মোটামুটি চলতে পারছি। কিন্তু এভাবে আর কত! বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটবে; এটা নিয়ে শঙ্কায় আছি। কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে বাকি সময়গুলোও সুখে চলতে পারতেন বলে জানান এই চা বিক্রেতা।
আরেক পরিচিত মুখ চাদঁপুর জেলার কচুয়া উপজেলার বাসিন্দা মধুর ক্যান্টিনের মান্নান। জানালেন, এখনো কোন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পাননি তিনি। মুঠোফোনে মান্নান জানান, আমার পরিবারে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী; বড়-ভাই ও তার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, বোনসহ মোট ১১ জন সদস্য। অন্যদিকে আয় করি শুধু আমি ও আমার এক ভাই। বাবা কোন কাজ করতে পারে না। সে হিসেবে কষ্ট তো হচ্ছেই।
মান্নান বলেন, দীর্ঘসময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দিন আর ভালো যাচ্ছে না। কোন কাজ করতে না পারায় বড় পরিবার নিয়ে এক ধরণের অসহায় অবস্থায় আছি। এর উপর আবার এখনো কোন সাহায্য পাইনি।
পরিচিত মুখ মধুর ক্যান্টিনের রুবেলও। রুবেল যখন ক্যাম্পাসে পা রাখে; তখন সবে ৭-এ পা দিয়েছে। গায়ে ছিল গেঞ্জি, পরনে হাফ-প্যান্ট। রুবেলের বয়স আজ ২৭। এই ২০ বছরে ছাত্রদলের আজিজুল বারী হেলাল, শফিউল বারী বাবু থেকে ছাত্রলীগের মাহমুদ হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন— সবাই তার হাতে চা খেয়েছে। অথচ তার শিশু থেকে শৈশব, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা কারো চোখে পড়েনি।’
করোনা-কালে কেমন আছেন ৬ সদস্য নিয়ে বাস করা সেই রুবেল? যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি আমার পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। রুবেল জানান, ক্যাম্পাসের এক বড় ভাই ও ডাকসু নেতা ১৫০০ টাকা পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া আর কোন সাহায্য পাইনি। এলাকা থেকেও ত্রাণ কিংবা অন্য কোনো সহযোগিতা না পাওয়া রুবেল জানান, ইউনিয়ন পরিষদে ভোটার আইডি কার্ড জমা দিয়েছি, কিন্তু এখনো পাইনি।
কথা হয় হল ক্যান্টিন বয়দের সঙ্গেও। তারা জানান, ক্যান্টিনে কাজ করে এমনিতেও নামমাত্র মজুরি পাওয়া যায়। তাছাড়া সেখানে কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোন কর্মঘন্টা বা সময়সীমা নেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠার পরপরই কাজ শুরু। আর রাতের খাবার বিক্রি শেষে ঘুমাতে যেতে হয় রাত ১১ টার পর। আর এখন তো কাজই বন্ধ। কথা বলতে গিয়ে অন্যদের মত তারাও ফেলেন দীর্ঘশ্বাস।