গবেষণা কম, রাজনীতিই বেশি পছন্দ ঢাবি শিক্ষকদের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ক্রমেই কমছে। শিক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে অনাগ্রহী। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার কেন্দ্রগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকছে। অন্যদিকে গবেষণার জন্য বাজেটের অভাব, গবেষণার অবমূল্যায়ন, গবেষণার প্রতিকূল পরিবেশ, শিক্ষকদের পদ-পদবীর লোভ সর্বোপরি রাজনীতিতে প্রবল ঝোঁক থাকার কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র-জুনিয়র অনেক শিক্ষকের সঙ্গে অালাপকালে এমনটাই অভিযোগ করেছেন তারা ।
অনেকে আবার জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ক্লাসরুম, আবাসন ও গ্রন্থাগারে যথাযথ পরিবেশ নেই গবেষণার জন্য। আবার যেসব শিক্ষক গবেষণা-কর্ম সম্পাদন করছেন উপযুক্ত প্রচারের অভাবে সেগুলো থেকে যাচ্ছে মানুষের অজানা। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা প্রকাশ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে তার মধ্যে মাত্র দুটি জার্নাল রয়েছে যেগুলো অনলাইন এনলিস্টেড। গবেষণার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যে সাইটেশনের দরকার তার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ কারণে এসব গবেষণায় কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা গবেষণা জালিয়াতির আশ্রয় নিলেও তা প্রকাশ্যে আসছে না। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গবেষণার চৌর্যবৃত্তি। যার কারণে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক রয়েছেন দুই হাজারের বেশি। গতি দুই দশকের ব্যবধানে শিক্ষক সংখ্যা বাড়লেও কমেছে গবেষণাপত্র ও প্রকাশনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ইতিহাস, অর্থনীতি, মার্কেটিং, রসায়ন, পদার্থ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান- এই সাত বিভাগে গত ৩০ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে এসব বিভাগে ১৮৮ জন শিক্ষকের অধীনে ২০৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সে অনুপাতে ওই একই বিভাগগুলোয় ২৫১ জন শিক্ষকের অধীনে ৩০০টি গবেষণাপত্র বের হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বের হয়েছে মাত্র ৬০টি। এর প্রায় ৮০ শতাংশ কম।
এদিকে বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী দেখা যায়, ২০১৭-১৮ সালে কলা অনুষদভুক্ত ১৭ বিভাগে গবেষণা মাত্র ৩৬টি, আর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২৬টি। বিজ্ঞান অনুষদে আট বিভাগে গবেষণা ১১৬, প্রকাশিত প্রবন্ধ বা আর্টিকেল ১৬ এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ৯ বিভাগে ৫২টি প্রবন্ধ বা পাবলিকেশন প্রকাশ পায়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ১৬ বিভাগে গবেষণা ৬৪, প্রকাশিত প্রবন্ধ বা বই ১৪; জীববিজ্ঞান অনুষদের ১১ বিভাগে গবেষণা ২১১, প্রকাশনা ২৩৩; ফার্মেসি অনুষদে গবেষণা ৬২, পাবলিকেশন ১০৪; আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের পাঁচ বিভাগে গবেষণা ৩৪, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদে গবেষণা ১৫৮, পাবলিকেশন ৪১; চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে গবেষণা চার এবং ১৩টি ইন্সটিটিউটে গবেষণা ১৮ ও পাবলিকেশন ৪৮টি।
গবেষণা ও পাবলিকেশন নেই ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি, সংগীত, ভাষাবিজ্ঞান, আইন, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালটি ম্যানেজমেন্ট, অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশীপ বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, অপরাধবিজ্ঞান, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন, মনোবিজ্ঞান, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, সমুদ্রবিজ্ঞান, দুর্যোগবিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইন্সটিটিউটে।
জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৮১০ কোটি ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে গবেষণায় বরাদ্দ ১৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ২.১ শতাংশ। এ অর্থবছরের বাজেটে গত বছরের চেয়ে ৯.৩৫ শতাংশ বরাদ্দ বাড়লেও গবেষণায় বরাদ্দ কমছে ২.৮৪ শতাংশ; যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষকদের গবেষণার ওপর।
বিভিন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- শিক্ষকরা গবেষণা করার মতো উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির জন্য যেটুকু গবেষণা দরকার তারা শুধু সেটুকু গবেষণা করে। পদোন্নতির পরে সেই গবেষণা আর সমৃদ্ধি করে না। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে গবেষণার চাইতে রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা বেশি। যে কারণে, শিক্ষকরা রাজনীতি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষকরা গবেষণা করতে চাইলেও বিভিন্ন পদ-পদবীর জন্য সিনিয়র শিক্ষকদের পেছনে ছুটতে হয়। রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়। যার কারণে তারা গবেষণা করতে পারে না।
আবার সিনিয়র শিক্ষকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক পদ-পদবীর সাথে জড়িত থাকা, ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন একাডেমিক পদ-পদবীতে থাকার কারণে তারা গবেষণা করতে সময় পায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয়না কয়েকটি কারণে। তার মধ্যে বাজেটের অপ্রতুলতা ও মূল্যায়নের অভাব। শিক্ষকরা গবেষণা করতে চায় কিন্তু বাজেট পায় না। আবার বাজেট পেলেও যে গবেষণা করে তার গবেষণার মূল্যায়ন নাই। যে কারণে শিক্ষকদের রাজনৈতিক ঝোঁক বেড়েছে। কারণ, রাজনীতি করলে নানান সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু গবেষণা করলে আর তেমন সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রভাষক বলেন, ‘আমার যেখানে গবেষণা করার কথা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সিনিয়রদের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। আমি যদি শুধুমাত্র গবেষণা করি, সিনিয়র শিক্ষকদের পেছনে না ছুটি তাহলে হয়ত আমার প্রমোশন হবেনা। আর হলেও অনেক দেরি হবে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে রাজনীতি করতে হয়। ’
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে গবেষণা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোনোক্রমেই গবেষণা কোথাও সংকুচিত হবে সেটা কাম্য নয়। গবেষণার জন্য অর্থের সম্ভাবনার যে ঘাটতি সেটিও না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বিবরণীতে গবেষণা কম থাকলেও মূলত আমাদের শিক্ষকরা আরো বেশি গবেষণা করছেন। শিক্ষকরা বার্ষিক বিবরণীতে উল্লেখ করার জন্য সেসব গবেষণা সময়মতো জমা দেন না। এটা ঠিক যে, কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যারা গবেষণায় কম আগ্রহী। তবে অসাধারণ কয়েকজন গবেষকও আমাদের রয়েছেন। আমরা আশা করবো যারা যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারা যেন সে বিষয়টিকে আরো সম্প্রসারিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধি করার জন্য গবেষণার বিকল্প কিছু নাই।’
গবেষণার বরাদ্দের অপ্রতুলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গবেষণার বরাদ্দ কম বেশির চেয়ে আরেকটি বিষয় আছে। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান থেকে গবেষণার প্রপোজাল পাওয়া গেলে সেগুলোর জন্য অর্থ সংস্থানের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেটির জন্য আমাদের কাছে যদি কেউ এপ্রোচ করে তাহলে আমাদের অকুণ্ঠ প্রয়াস থাকবে।’
শিক্ষক রাজনীতি গবেষণার ওপর কোনো প্রভাব পড়ে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিমনা শিক্ষক থাকবে। এটির কারণে গবেষণা থেমে যাবে সেটি কখনো হতে পারেনা। রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার ফলে বেশি সুবিধা পেল এমন কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নাই।’
ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল বা কলেজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় যদি গবেষণা না করে তাহলে কিভাবে জ্ঞান বিতরণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছেনা এটা দুঃখজনক। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছেনা জ্ঞানের চর্চার মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু গবেষণা নয় প্রকাশনাও দরকার।