ডাকসু নির্বাচনের বর্ষপূর্তি, আলোচনায় নেই নতুন নির্বাচন
দীর্ঘ ২৮ বছর প্রতীক্ষার পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ সচল হয়েছিল একসময় দেশের ‘সেকেন্ড পার্লামেন্ট’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। আজ বুধবার(১১ মার্চ) ডাকসু নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হলো।
তবে, ডাকসু নির্বাচনের গঠনতন্ত্রে কমিটির মেয়াদ ১ বছর বলা হলেও যথা সময়ে নতুন নির্বাচন নিয়ে কোন আলোচনা নেই। কবে নাগাদ আলোচনা হতে পারে তা স্পষ্ট করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও ডাকসু নির্বাচনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটিকে ক্যালেন্ডার ইভেন্ট হিসেবে চালু রাখার কথা বলেছিল।
শিক্ষার্থীরা বলছে, বহু ত্যাগ ও আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে হয়েছিল ডাকসুর নির্বাচন। অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তাদের মূল প্রত্যাশা পূরনে ব্যর্থ হয়েছে ডাকসু। ডাকসু নির্বাচনে মোট ২৫টি পদের মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গড়ে উঠা প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ থেকে ভিপি পদে নুরুল হক নুর এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আখতার হোসেন।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ প্যানেল থেকে জিএস গোলাম রাব্বানী, এজিএস সাদ্দাম হোসাইনসহ সংগঠনটির ২৩ জন নির্বাচিত হন। অভিযোগ রয়েছে, ডাকসু প্রতিনিধিদের মধ্যে ২৩ জন ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত হওয়ায় সব সময় তারা ডাকসুতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। তারা ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে সকল কাজ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে ডাকসু ভিপি ছাত্রলীগ প্যানেলের বিরোধিতার অজুহাত দিয়ে কোন কাজ করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার ছাত্রলীগ প্যানেলের মধ্যে সবসময় অভ্যন্তরীন কোন্দল ছিল।
ডাকসুতে নির্বাচিত ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দুই প্যানেলেরই নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট নিরসন, গণরুম-গেস্টরুম প্রথা উচ্ছেদ, হল থেকে অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন, সান্ধ্যকোর্স বন্ধ, পরিবহন সমস্যার সমাধান, ক্যান্টিনে খাবারের মান বৃদ্ধি, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল, ক্যাম্পাসে বাইরের যান চলাচল বন্ধ প্রভৃতি। এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেননি ডাকসু নেতারা।
তবে কয়েকটি বিভাগের উন্নয়ন ফি কমানো, হলের ফি কমানো, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজন, সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ, ছাত্রী হলসহ বিভিন্ন রুটে পরিবহন বৃদ্ধি, লাইব্রেরি খোলার সময়সীমা দুই ঘণ্টা বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের সাস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণে ট্যালেন্ট হ্যান্ট প্রতিযোগিতার আয়োজন, অ্যাপভিত্তিক বাইসাইকেল সেবা চালু ইত্যাদি কাজ করেছেন। তবে, এসব কাজ বিচ্ছিন্নভাবে ডাকসুর কয়েকজন সদস্য নিজ উদ্যোগেই করেছেন।
এ নিয়ে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সালমান বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থীরা যে পরিমাণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অনেকাংশই পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ২৮ বছরে সমস্যার পাহাড় জমেছিল। আর নির্বাচিত হওয়ার পর ডাকসু নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। সদিচ্ছা ও অর্থের অভাবেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না অনেক ইশতেহার। যদিও ডাকসু নেতারা বলছেন, আবাসন, গবেষণায় বরাদ্দ, খাবারের মানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা রয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলো। ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। শিক্ষার্থীদের যতটুকু প্রত্যাশা ছিল ডাকসু তার অনেকাংশ পূরণ করতে না পারলেও অনেক অর্জন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘গত বারের নির্বাচন ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। এবারের নির্বাচন এখনো আলোচনায় নাই। ২৮ বছর পর ডাকসু হয়েছিল আবার মনে হচ্ছে এ যাত্রাটা থেমে যাচ্ছে। প্রশাসনের ডাকসু নিয়ে ভাবনা নাই। উপাচার্য ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। এর পেছনে কারণ থাকতে পারে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে খুশি করা। তবে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাইলে ডাকসু নির্বাচন হতে পারে।’
এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর পর নির্বাচন হয়েছে। আমাদের সফলতা ব্যর্থতা দুটোই রয়েছে। তবে, শিক্ষার্থীদের জন্য আরো করা যেত যদি ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর দূতাবাস কেন্দ্রীক রাজনীতি না করে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরনে কাজ করতেন।
তবে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে শেষ কয়েকদিন ভাল কাজ করেছে ডাকসু। আগামী নির্বাচনে বর্তমান প্রতিনিধিরা ডাকসু নির্বাচন করবেন এ লক্ষ্যে কাজ করেছেন বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে। তবে, কবে নাগাদ ডাকসু নির্বাচন হবে তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০১৯ সালে ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ওই বছরের ২৩ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করে নির্বাহী কমিটি। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ডাকসুর কমিটি ১ বছর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাবে। নির্বাচন না হলে সেক্ষেত্রে ডাকসুর সভাপতি ৯০ দিন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারবেন। সে হিসেবে ২৩ মার্চ ডাকসুর মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা, কমিশন গঠন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
অপরদিকে ডাকসু গঠনতন্ত্রে নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই উল্লেখ নেই। গঠনতন্ত্রের প্রথম খন্ডের ৮ এর ৯ (ব)তে বলা হয়েছে, সভাপতি নির্বাচনের সময় এবং তারিখ ধার্য করে তা অবহিত করবেন এবং একজন প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলি আবাসিক হল আছে ততজন নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন।
এ বিষয়ে গত নির্বাচনে প্রধান রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত উপাচার্য সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করে ঠিক করেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর কমিশনের কার্যকারিতা থাকে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাকসু সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ২৩ তারিখের পর আমরা এটি নিয়ে আলোচনায় বসতে পারি। আলোচনা করে পরবর্তিতে বিষয়টি জানানো হবে।
এদিকে আগামী নির্বাচন হোক বা না হোক ইতিমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে ছাত্র সংগঠনগুলো। জানা যায়, ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর এবার নির্বাচন করছেন না। তার অবর্তমানে তার সংগঠনের আখতার হোসেন, রাশেদ খান, ফারুক হাসান, হাসান আল মামুন আলোচনায় রয়েছেন।
আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসাবে ডাকসু নির্বাচনের ছাত্রলীগ প্যানেলে ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়েছে। এ প্যানেল থেকে সাদ্দাম হোসেন, আসিফ তালুকদার, তানবীর হাসান সৈকত সহ প্যানেলের বাইরে থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়, সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টচার্য আলোচনায় রয়েছেন। অন্যদিকে ছাত্রদল এবং বাম সংগঠনগুলোর নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন। আমরা সবসময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল বলেন, ‘আমরা চাই অতিদ্রুত ডাকসু নির্বাচনের জন্য প্রশাসন তারিখ ঘোষণা করবে। প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট দিনে ডাকসু নির্বাচন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। তবে গতবারের মতো নির্বাচন যেন না হয় সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা একটি ছাত্র সংগঠন হিসাবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।’