নুর যেন মার খেয়ে দাবি আদায়ের অন্য নাম!
২০১৮ সালের জুন মাস। কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সরকারি চাকরিতে ৫৫ ভাগ কোটা থাকার বিষয়টি যখন সর্বমহলে নাড়া দিচ্ছিল, ঠিক তখনই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আসল শুরুটা মূলত তখনই, এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই শক্তিশালী হয়েছে এই আন্দোলন। আদায় করেছে কোটা সংস্কারের ‘এক দফা’ দাবি। অন্যদিকে গ্রাজুয়েট বেকারদের এই আন্দোলনের ডামাডোলে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের; সর্বজনের কাছে যা ‘কোটা সংস্কার দল’ হিসেবেই পরিচিত।
কিন্তু কোটা সংস্কার পরবর্তী এই সংগঠনের যাত্রা শুধু কোটাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কথা বলেছে জাতীয় রাজনীতি এমনকি আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়াদি নিয়েও। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি এখন জাতীয় রাজনীতিতে আলোচিত হচ্ছে, তা হলো— এই সংগঠনের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ডাকসু ভিপি নুরের ওপর হামলা। আওয়ামী লীগ তো বটেই, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি নজরে এনেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন ব্যবস্থা নিতে। সমালোচনায় মেতেছেন বিএনপির হাইকমান্ডসহ অন্যান্যরাও।
তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, কোটা সংস্কার দাবি নিয়ে যতবারই আন্দোলন হয়েছে, ততবারই কোন না কোনভাবে বাঁধার শিকার হয়েছে এই সংগঠনের নেতাকর্মী ও তাদের সঙ্গে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও নেতাকর্মীর বক্তব্যের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত মোট ৯বার হামলার শিকার হয়েছেন তারা; এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টার্গেটের শিকার হয়েছেন সংগঠনের যুগ্ম-আহ্বায়ক ও ভিপি নুরুল হক নুর।
সূত্রের তথ্য, ২০১৮ সালের ৩০ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মারধরের শিকার হয়েছিলেন ভিপি নুর। যা ছাত্রসমাজ তো বটেই, জাতীয় রাজনীতিতেও বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সে সময় হামলার নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও হল নেতাকর্মীদের দেখা গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ নুরদের।
শুধু গ্রন্থাগারের সামনেই নয়, এর আগে-পরেও একে একে নয়বার ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন নুরুল হক নুর। এর মধ্যে চলতি বছরেই আটবার। এছাড়া ভিপি হওয়ার আগে দু'বার এবং ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর সাতবার হামলার শিকার হন তিনি। যদিও এসব ঘটনার বিচার তো দূরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয় এমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেও ওই অর্থে কোনো সহযোগিতা পাননি দাবি নুরের। অন্যদিকে হামলার ঘটনায় বারবারই দায় অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা।
জানতে চাইলে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার ওপর চালানো সব হামলাই একটি পক্ষ করেছে। তাদের পরিচয় হলো ছাত্রলীগ, এর বাইরে কেউ নেই। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যে নয়বার হামলা হয়েছে, তার প্রত্যেকবারাই ছাত্রলীগ কোনো না কোনো লেবাস নিয়ে এসেছে। এমনকি সর্বশেষ হামলাকারীও তারাই।
গণমাধ্যমের তথ্য, গ্রন্থাগারে চত্বরে হামলার পরে নুরের ওপর আবার হামলা চালানো হয় ১২ মার্চ, ২০১৯। নেতাকর্মীরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন চলাকালীন ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে ‘ভোট ডাকাতি’ হচ্ছে- এমন খবর আসে নুরের কাছে। খবর পেয়ে তিনি ও তার সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাকর্মীরা রোকেয়া হলে গেলে সেখানেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। নির্বাচনে জয়ের পরদিনও টিএসসিতে হামলার শিকার নুর ও তার সহযোগীরা।
আরেক দফা হামলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে। তারিখ ২ এপ্রিল, ২০১৯। এদিনই হলের শিক্ষার্থী ফরিদ হাসানকে মেরে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করতে গেলে সেখানেই নুরসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বেধরক মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন নুরসহ ২০ থেকে ৩০ জন।
নুরের ওপর নির্যাতন এখানেই থেমে নেই। গত রমযান মাসেও নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়া গিয়ে আরেক দফা হামলার শিকার হন তিনি। তার দাবি- সে সময়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পাননি তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক দফা হামলার শিকার হন বগুড়ায়। ২৬ মে নিজ সংগঠনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইফতার মাহফিলে যোগ দিতে গেলে জেলা শহরের উডবার্ন লাইব্রেরি চত্বরে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাসের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ওই হামলা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানায়।
নিজ এলাকাতেও হামলার শিকার হয়েছেন তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই ছাত্রনেতা। প্রতিপক্ষ এবারও সেই পরিচিত মহল। ঈদে বাড়িতে যাওয়ার পর ১৪ আগস্ট পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উলানিয়া বন্দরে হামলার শিকার হন তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতির নেতৃত্বে সেই হামলা চালানো হয়েছিল বলে দাবি স্থানীয়দের।
নুরের ওপর অষ্টমবারের মতো হামলা চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতাকর্মীরা। ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ভারতের জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে হামলার শিকার হন তিনি। হামলায় নুরসহ ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতারও আহত হন। ওই দিন সন্ধ্যায় ভিসির কাছে অভিযোগ দিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ফের হামলার শিকার হন নুরের সহযোগীরা।
সর্বশেষ সপ্তাহ না পেরোতেই গত রবিবার আরেববার হামলার শিকার হন এই নেতা। স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনস্থ নিজ কক্ষ। ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতাকর্মীরা যৌথভাবে এই হামলা চালায়। এতে নুরসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। এ নিয়ে নবম বারের মতো নুরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে হারিয়ে ভিপি নির্বাচিত হন নুর। সেই সময় থেকেই আলোচনায় আসেন তিনি। দেশের ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা ডাকসুর সহ-সভাপতির পদে থেকেও বারবার তার ওপর হামলার ঘটনায় জনমনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে মার খেতে খেতে ভিপি হন তিনি। মার খেয়ে দাবি আদায় করার নামই যেন নুরুল হক নুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।