আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে যেতে দিন—ঢাবি শিক্ষকের আকুতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. রুশাদ ফরিদীর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের দেয়া জবরদস্তিমূলক ছুটির আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেছেন উচ্চ আদালত। একইসঙ্গে তাকে কাজে যোগদান করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত ২৫ আগস্ট এ আদেশ দেন আদালত।
এদিকে, গত সোমবার যোগদানের কাগজপত্র বিভাগের অফিসে জমা দিতে গেলে অফিসের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা জানিয়েছেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার জানিয়েছেন উনার অনুমতি ছাড়া কোন চিঠি রিসিভ করা যাবে না’। বিষয়টি নিয়ে সোমবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ড. রুশাদ ফরিদী। সেখানে তিনি তার শিক্ষকতায় ফেরার পথটা বেশ কঠিন হবেই বলে মন্তব্যে করেন।
এদিকে, মঙ্গলবার রতে ড. রুশাদ ফরিদী ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন। এতে তার একটি ছবি দিয়েছেন ড. রুশাদ ফরিদী। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে, ‘আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে যেতে দিন’।
এছাড়াও সেই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আজকের দিনের ঘটনা নিয়ে কতটুকু জল ঘোলা হবে জানি না, একটু বিস্তারিত বলি। ছবির প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মহোদয়ের কক্ষের সামনে। এক ফাঁকে অন্যদিকে গিয়েছিলাম। তারপর এসে শুনলাম তিনি এসেছেন শুনে দেখা করতে গেলাম। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল যে তিনি আমার গতকালকের রেখে দেয়া চিঠি পেয়েছেন কিনা।
দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম। উনি বললেন কি বিষয়? আমি একটু ভেতরে ঢুকতে আমার প্ল্যাকার্ডে উনার চোখ পড়ল। উনি আমাকে ডাকলেন ভেতরে আসতে। আসতেই বললেন তুমি কেন বারবার আমার কাছে আসছো? এই প্ল্যাকার্ড নিয়ে তুমি কেন ভিসির অফিসে যাচ্ছো না? আমি কি করতে পারি?
আমি বললাম স্যার আপনাদের অভিযোগের উপর ভিত্তি করেই তো উনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই আপনারাই পারেন এর সুষ্ঠ সমাধান করতে। তাছাড়া বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে সুষ্ঠ সমাধানের চেষ্টা করাটা আপনার দায়িত্বের উপরেও পরে।
এই ধরনের কথোপকথনের এক পর্যায়ে উনি হঠাৎ প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন। লাফ দিয়ে উঠে যেয়ে বললে তুমি আমার সাথে আসো। আমি পেছনে পেছনে গেলাম। উনি বিভাগের দু'একজন কর্মচারীকে বললেন বাকী শিক্ষক যারা যারা আছেন সবাইকে খবর দিতে।
তো খবর পেয়ে একজন দুইজন করে আসলো। প্ল্যাকার্ড হাতে আমাকে চিড়িয়াখানা থাকা কারো দিকে তাকিয়ে থাকার মতন করে তাকিয়ে কেউ কেউ চলে গেলেন। তবে একজন শিক্ষক পুরোটা সময় থাকলেন। তিনি সেই ২০১১ সাল থেকে আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সত্য মিথ্যার প্রলেপ মিশিয়ে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষিকাকে উত্তেজিত করেছেন। আমাকে দুই দুইবার বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পেছনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আট নয় বছরেও দেখলাম এই বিষয়ে উনার উৎসাহের বিন্দুমাত্র কমতি নেই। আমি উনার এই বিষয়টিতে এই রকম অধ্যবসায় দেখে বিমোহিত হলাম। হয়তো তিনি এইবারেও সফল কাম হবেন।
যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে একজন সহকারী প্রক্টর আসলেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান স্যার বিভাগের কর্মচারীদের সামনে আমাকে প্রচুর বকাঝকা করলেন। এরপর সহকারী প্রক্টর , চেয়ারম্যান স্যার আর ওই প্রচন্ড উৎসাহী শিক্ষক মিলে অনেকক্ষণ চেয়ারম্যানের কক্ষে আলাপ আলোচনা করলেন। তারপর উনারা বেড়িয়ে গেলেন। আমিও আরো কিছুক্ষণ প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসলাম।
তো এর মধ্যে কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রী এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমি খুবই অবাক হলাম। কারণ আমি আমার বাধ্যতামূলক ছুটির বেশীর ভাগ সময়েই দেখেছি ছাত্র ছাত্রীরা আমার সাথে কথা বলতে খুবই অস্বস্তি বোধ করে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি বিভাগে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে আমার সাথে সোশাল মিডিয়া বা অন্য কোন ভাবে যোগাযোগ থাকলে ইট হ্যাজ কনসিকোয়েন্স। কি ধরনের সেটা নিশ্চয়ই খোলাসা করে বলে দিতে হবে না।
তো ওরা এসে আমার সাথে কিছু কথা বললো। আমি বললাম, তোমাদের দেখি অনেক সাহস! কারো কারো চোখে মুখে বিষাদ বেদনার ছাপ খুবই স্পষ্ট। একজন বলল স্যার, আমরা তো প্রতিবাদ করা ভুলেই গেছি। তাই আপনাকে দেখে খুবই অবাক লাগে। আরেকজন তো আমার পাশে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকল। তার চোখ ছল ছল। বলল, ভাবছি আমি আপনার পাশেই থাকি সারাক্ষণ।
আমি বললাম, দেখো এই নিয়ে তোমরা ঝামেলায় পড় সেটা আমি কোনমতেই চাই না। এইটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত যুদ্ধ। এটা আমি একাই লড়ে এসেছি। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই পাশে পাই নাই। এটা একা লড়তে লড়তেই আমি অভস্ত্য। এর জন্য আমি আমার ছাত্র ছাত্রীদের বিপদে ফেলতে চাই না।
বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। তারপর এসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। সেখানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কেন?
আমাকে এইরকম একটাই প্রশ্ন আজকে আমি যখন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একজন ছাত্রী প্রশ্ন করেছিল? স্যার আপনি কেন এইখানে আছেন? কেন আপনি এরকম ভাবে সাফার করছেন?
আমি উত্তর দিলাম, আমি এইখানে আছি, সাফার করছি, যুদ্ধ করছি, সংগ্রাম করছি, তোমাদের জন্যই। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি ছাত্র ছাত্রীদের পড়াতে। তাঁদের শেখাতে, তাঁদের জীবনে সামান্য কিছু হলেও জ্ঞান, দক্ষতা এনে দিতে যেটা তাঁদের পরবর্তী জীবনের সহায়তা করতে। আমার কারণে যদি একটিও ছাত্র বা ছাত্রীর জীবনে পজিটিভ কোন পরিবর্তন আসে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে?
আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশে এইটাই আমার জন্য সবচেয়ে মহত্তম কাজ। এর চেয়ে বেশী সন্তুষ্টির কাজ আমার জন্য এই দেশে আর নেই। তাই আমি এখানে মাটি কামড়ে পড়ে আছি। থাকব।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ১২ জুলাই ড. রুশাদ ফরিদীকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটিতে পাঠানোর চিঠি দিয়েছিল ঢাবির সিন্ডিকেট। চিঠি বাতিল পুনর্বিবেচনার দাবিতে উপাচার্যসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন সেই শিক্ষক। ঢাবির উপাচার্য, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), উপ-উপাচার্য (প্রশাসন), রেজিস্টার, বিভাগের সভাপতি বরাবর এই নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।
এর আগে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এই শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রুশাদ ফরিদীর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ জন শিক্ষক অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগে শিক্ষকরা বলেছিলেন, রুশাদ ফরিদীর সঙ্গে তারা কাজ করবেন না। এরপর রুশাদ ফরিদীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।