ডাকসুর ৩৮ পৃষ্ঠার সাহিত্য পত্রিকায় যত ভুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্লোগান’ প্রবন্ধের তৃতীয় লাইনে বলা হয়েছে ‘৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে’। শুধুমাত্র একটি প্রবন্ধে নয় বরং ৩৮ পৃষ্ঠার পত্রিকায় এমন শতাধিক ভুল চোখে পড়েছে। এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়ন।
বানান ভুল, মানসম্পন্ন বাক্য গঠনে অপারগতা, যতি চিহ্নের যথেচ্ছা ব্যবহারে ম্যাগাজিনটির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। তারা বলছেন, যে প্রকাশনার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডাকসুর নাম জড়িয়ে আছে সেই পত্রিকায় এতো ভুল খুবই অপ্রত্যাশিত। তবে এ নিয়ে সাফাই গেয়েছেন ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন।
ডাকসুর ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি পড়ে এর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুরো পত্রিকাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের লেখা এবিএম মূসা’র ‘মুজিব ভাই’ প্রবন্ধ ও কয়েকটি কবিতা ছাড়া অন্য সব লেখনীতে বানান ভুল, বাক্য গঠনে সমস্যা, যতি চিহ্নের যথেচ্ছ ব্যবহারের মতো ঘটনা ঘটেছে।
পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়ই দুইজন সহ-সম্পাদকের নামের বানানে ভুল করা হয়েছে। সম্পাদকীয়তেও রয়েছে বেশ কয়েকটি ভুল। এই অংশে লেখা হয়, ‘ত্রিশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য চর্চার কেমন পরিবর্তিত হয়েছে।’ অথচ সেখানে লেখা উচিত ছিলো; ‘ত্রিশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য চর্চার কেমন পরিবর্তন হয়েছে’ অথবা ‘ত্রিশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য চর্চা কেমন পরিবর্তিত হয়েছে- এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
ম্যাগাজিনটির ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় নির্মলেন্দু গুণের লেখা ‘কবির সতর্কবাণী’ কবিতায় ‘পড়েছি’ শব্দকে লেখা হয়েছে ‘পরিছি’। জাহিদ হাসানের লেখা ‘মৃত্যুকাব্য’ গল্পে ভুল রয়েছে বিশেরও অধিক। এসব ভুলের মধ্যে রয়েছে- অস্পস্ট, আগুন খুন আতঙ্ক, কারন, তকন, বায়না করেছিলো, পৌরষত্ব, হইছে, ছেলেপক্ষরা, পৌছে, মুহুর্তের, খুজতে, চেচামেচি, ঝাপড়া, অন্ত:স্বত্তা ইত্যাদি। সঠিক শব্দগুলো হলো যথাক্রমে- অস্পষ্ট, ‘আগুন, খুন, আতঙ্ক’, কারণ, তখন, বায়না ধরেছিলো, পুরুষত্ব, হয়েছে, ছেলেপক্ষ, পৌঁছে, মুহূর্তের, খুঁজতে, চেঁচামেচি, ঝাপসা, অন্তঃসত্তা।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবগাঁথা’ শীর্ষক সংকলনে ভুলের মধ্যে রয়েছে- বহিস্কৃত, ঔদাসিন্য, সত্বেও, পশ্চাদপদ, দুর্নীবার, অপাংতেও, বরণ্যে, পুথিঁ ইত্যাদি। সঠিক শব্দগুলো হলো যথাক্রমে- বহিষ্কৃত, ঔদাসীন্য, সত্ত্বেও, পশ্চাৎপদ, দুর্নিবার, অপাংক্তেয় বা অপাঙ্ক্তেয়, বরেণ্য, পুঁথি।
কবিতাও বাদ যায়নি এই ভুল থেকে। কিষাণ সাহার লেখা কবিতা ‘বিনীতার জন্য’ কবিতায় ‘গাঁথা’ শব্দকে লেখা হয়েছে ‘গাথাঁ’ হিসেবে। রনো আনোয়ারের লেখা ‘শাওয়ারের হাতল’ কবিতায় ‘নিষ্প্রাণ’ শব্দকে লেখা হয়েছে ‘নিস্প্রান’ হিসেবে। ফখরুল ইসলাম কল্পের ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ কবিতায় ‘মেয়ের’ শব্দকে লেখা হয়েছে মেযের, ‘কেটে’ শব্দকে লেখা হয়েছে কেঁটে, ‘মুহূর্ত’ কে লেখা হয়েছে মুহুর্ত। জীগল মন্ডলের লেখা ‘শুনছো জুবুর আব্বু’ চিঠিতে চিঠি প্রেরকের নাম প্রথমে দেয়া হয়েছে ‘কাস্তুরী’। পরবর্তীতে এ নামকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে ‘কান্তরী’। এমন অসংখ্য ভুলে জর্জরিত এ সাহিত্য পত্রিকা।
পত্রিকাটিতে সায়ন্তন সৈকত রায়ের লেখা গল্প ‘অবচেতন’ সম্পর্কে এক শিক্ষার্থী বলেন, গল্পটির বাক্য গঠন এতই নিম্মমানের, বাক্যের মধ্যে পাঠককে লেখক কি বলার চেষ্টা করেছেন তা বুঝতে আমাকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এসব বিষয়ে অবহিত করা হলে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দশক পরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পর এটি ডাকসুর প্রথম সংখ্যা। পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকবে। এসব বিষয়ে নজর না দিয়ে যারা এর খুঁত ধরতে বসে থাকে, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব করছে।
ডাকসু ভিপি নুরুল হক বলেন, সাহিত্য পত্রিকায় ভুল ডাকসুর জন্য সম্মানহানিকর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জাজনক। পত্রিকা প্রকাশের জন্য পরিকল্পনা দরকার ছিল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কমিটি করা উচিত ছিল। কিন্তু এ ধরণের কিছুই করা হয় নি। ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক নিজেই এটা বের করেছেন। সে জন্যই এ কাজ মানসম্মত হয়নি। বাজেটের খরচে খাত দেখানোর জন্য এটি করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
পত্রিকায় এমন ভুলের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, এরকম ভুল কেন হবে। সম্পাদকের তো উচিত ছিল ভুল দেখা এবং অন্যদের সহায়তা নেয়া। তিনি বলেন, সাহিত্য পত্রিকায় ভুলের বিষয়ে ডাকসুর কমিটিতে আলোচনা করে আগামী সংখ্যা থেকে কিভাবে পত্রিকাকে ভুলমুক্ত করা যায় তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ বিষয়ে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ও ‘ত্রৈমাসিক ডাকসু সাহিত্য পত্রিকা’র সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, সম্পাদনায় ত্রুটি ছিল। তবে, শতাধিক ভুল ছিল না। তিনি বলেন, আমরা সম্পাদনা পরিষদ নতুন করে সাজিয়েছি। আশা করছি, পরবর্তী সময়ে এমন ভুল আর হবে না।