০৫ অক্টোবর ২০১৯, ১১:১৮

ডাকসু নির্বাচনের পরে আবাসন সঙ্কট আরো বেড়েছে

  © টিডিসি ফটো

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ১৯২১ সালে ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪ হাজার ছাড়িয়েছে। শিক্ষার্থী বৃদ্ধির সাথে আবাসন সক্ষমতা না বাড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য।প্রতিষ্ঠানকালীন সময় থেকে আবাসন সুবিধা নিয়ে পথচলা শুরু করলেও বর্তমানে তীব্র আবাসন সঙ্কট ঢাবিতে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। জাতি হারাচ্ছে মেধাবী, দক্ষ ও উন্নত মানবসম্পদ।

আবাসন সমস্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত নানা সভা-সমাবেশ, আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও সঙ্কট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠবিদ্যাপীঠে আবাসন সঙ্কট কেন এতো প্রকট আকার ধারণ করেছে তার কোনো সুস্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন বড় প্রভাব ফেলছে বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। আগে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সিট পলিটিক্সের কারণে দৃশ্যমান আবাসন সঙ্কট থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পরে সে সঙ্কট কমার কথা থাকলেও কার্যত আরো বেড়েছে।

বর্তমানে ঢাবির হলে আবাসনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে ছাত্রদের হলের সিট বরাদ্দ দেয় যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তার সহযোগী বা ভাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন । বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে হল নিয়ন্ত্রন করছে ছাত্রলীগ। এখানে হল প্রশাসন নীরব দর্শক। হল রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রণ করায় যে শিক্ষার্থী রাজনৈতিকভাবে যত ক্ষমতা সম্পন্ন তার সবার আগে হলে থাকার সুযোগ পায়, এক্ষেত্রে মেধার গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

বর্তমানে হলে ছাত্রলীগের আধিপত্য থাকায় হলে সিট দেওয়ার ক্ষেত্রে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকের কথায় অলিখিত বিধান। আধিপত্য থাকায় হলের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক থাকেন সিঙ্গেল রুমে । তার পাশাপাশি তাদের কাছের জুনিয়র নেতারাও সিঙ্গেল রুম বা সিঙ্গেল বেডে থাকে।

একাধিক হলে সরেজমিন দেখা যায়, অরাজনৈতিক রুমগুলোতে প্রতি রুমে যেখানে ৮ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকে সেখানে রাজনৈতিক রুমগুলোতে একজন থেকে সর্বোচ্চ চার জন থাকে। তাছাড়া রাজনৈতিক সংগঠন হল পরিচালনার সুবাদে হলে তাদের আশ্রয়ে থাকে অছাত্র, বহিরাগত । অভিযোগ রয়েছে সিঙ্গেলরুমের নেতারা প্রায়ই রুমে মাদক সেবন করেন।

ছাত্রসংগঠন হল নিয়ন্ত্রণ করায় নিশ্চুপ বিশ্ববিদ্যালয় হল প্রশাসন। হল প্রশাসনের প্রাধ্যক্ষরা রাজনৈতিক নানা সুবিধা পাবার আাশায় তাদের সাথে লিয়াজোঁ করে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি হল প্রশাসন রাজনৈতিক নানা সুবিধা পাবার আশায় হলের রাজনৈতিক দলের নেতাদের নানা নিয়োগ বানিজ্যসহ টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করে।

তবে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পর থেকে আবাসন সঙ্কট কমার বদলে তা আরো বেড়েছে। ডাকসু নির্বাচন হওয়ার আগে হলে প্রভাব ছিলো ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ-সম্পাদকের। কিন্তু নির্বাচন হওয়ার পরে তাদের সাথে যোগ হলেন আরো দুজন। তারা হলেন হলের ভিপি জিএস। হলের সিটগুলো রাজনৈতিক কারণে হল শাখার ছাত্রলীগ নেতা, কেন্দ্রীয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল সংসদ নেতাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে সেই আগের মতোই বঞ্চনাই রইলো।

ডাকসু নির্বাচনে হলের ভিপি জিএস নির্বাচিত হওয়ার পর অধিকাংশ হলে নির্বাচিত ভিপি জিএস রুম থেকে অন্যদের বের করে অথবা অন্য রুম খালি করে তাদের রুম সিঙ্গেল করে নিয়েছেন। যে রুমে কমপক্ষে আটজন থাকত সেই রুমে একাই থাকছেন তারা। শুধু ভিপি-জিএস নয় হল সংসদের দাপটে অনেক নেতা হল সংসদের নেতা হওয়ার পর তাদেও রুম সিঙ্গেল করে নিয়েছেন। সিঙ্গেলে বেডে উঠে অনেক পাতি নেতারাও। যা গোটা আবাসন ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ফলে সঙ্কটের চিত্র আরো করুণ মাত্রায় ধরা দিয়েছে।

এফ আর হলের হল সংসদের জিএস রাহিম সরকার। থাকেন ৪০৯ নম্বর রুমে । আগে থাকতেন আট জনের কক্ষ ৩১৭ নম্বর রুমে । জিএস হওয়ার পর তিনি সিঙ্গেল রুম নিয়েছেন । বঙ্গবন্ধু হলের ভিপি আকমল হোসেন । আগে থাকতেন ৩১৭ নম্বর রুমে । এখন থাকেন ২২০ নম্বর সিঙ্গেল রুমে । অভিযোগ রয়েছে তিনি হলের রুমে মাদক সেবন করেন। তবে সিঙ্গেল রুমে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি । তাদের মতো অধিকাংশ হল সংসদের নেতারা সিঙ্গেল রুমে থাকেন। সিঙ্গেল রুমে থাকার বিষয়ে আকমল হোসেন বলেন, ‘আমি সিঙ্গেল রুমে থাকি না। আমরা রুমে তিনজন থাকি।’

আবাসন সংকট নিয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা এখন ২য় বর্ষে পড়ছি, হলের অবস্থা এখন এই যে একটা সিটও খালি নেই। যার ফলে আমরা এখনো সেই গণরুমেই আছি। কর্তৃপক্ষকে তা জানালে উনারা আমাদেরকে আশ্বাস দেন, কিন্তু এই আশ্বাসের বাস্তবায়ন এখনো দেখতে পাইনি। ফলে আমরা তীব্র আবাসন সংকটে ভুগছি। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।’
জানতে চাইলে রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী হামিমা আহম্মেদ বলেন, ‘হলে আবাসিক সিটের জন্য আবেদন করেছি, কিন্তু দেড় বছর হয়ে গেলেও, আমি হলে উঠতে পারছি না। তিনি বলেন, হলে আবাসিক সংকটের কারণে পলাশী স্টাফ কোয়ার্টারে অন্যান্য বান্ধবীর সঙ্গে সাবলেটে থাকছি আমি। চার জন মিলে একটি রুম ভাড়া করে কোনো রকমে থাকি। নিরাপত্তার খুব একটা সমস্যা না হলেও বছরখানেক ধরে এই সাবলেট থাকা। তবে আবাসিক হলগুলোতে মেধায় আসার চেয়ে রাজনৈতিকভাবে উঠলে সিট বরাদ্দ হয় তাড়াতাড়ি। এ জন্য রাজনৈতিক একটা চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় পুরোটা শিক্ষাজীবন।’

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি (সহ-সভাপতি) নূরুল হক নূর বলেন, ‘হলগুলো প্রশাসন চালানোর কথা থাকলেও চালাচ্ছে রাজনৈতিক সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেরুদণ্ডহীন হওয়ায় অনৈতিক আচরণের মধ্য দিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো দখলদারিত্ব বা রাজনৈতিক দাসত্বের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে তারা রাজনৈতিক কমসূচী চালায়। সুতরাং এ অবস্থার জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী। হল প্রশাসন যদি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করতেন তাহলে এমন হতো না। শিক্ষক নামের কলঙ্ক এসব শিক্ষকদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে ।’

ঢাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় । তবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপাসিটির তুলনায় বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করছি যার ফলে আবাসন সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তবে, হলের সিট সঙ্কটে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিষয় ও ডাকসু নির্বাচনের প্রভাবের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।