চিরকুটে ভর্তি অনিয়ম বলছে সবাই, বিপরীত অবস্থান প্রশাসন ও ছাত্রলীগের
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে চিরকুটের মাধ্যমে ৩৪ শিক্ষার্থীকে ভর্তি এবং তারমধ্যে আট নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতা হওয়ায় বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর বিষয়টিকে অবৈধ বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম এতে কোন ধরণের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারা এ ‘অনিয়মের’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভিসি এবং ডিনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এছাড়া যারা ডাকসুর নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তারাসহ সবাইকে পদ থেকে অব্যাহতি ও বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করানোকে কোনভাবেই ভালো চোখে দেখছেন না কেউ। এভাবে ‘অনিয়ম’ করা হলে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে তারা মনে করছেন। যাদেরকে এভাবে চিরকুটের মাধ্যমে ভর্তি করা হয়েছে তারা সবাই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা। তবে এতে কোন অন্যায় দেখছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগটন ছাত্রলীগ।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর নির্বাচনের কিছুদিন আগে তারা ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ওই কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই ভর্তি হয়েছেন এবং ডাকসুর নেতা হয়েছেন।
বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, ইভিনিং প্রোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এটা অনুষদের নিজস্ব প্রোগ্রাম। আসন খালি থাকা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সার্কুলারের বাইরেও ভর্তি করানোর সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা একবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছে, দ্বিতীয়বার দেয়ার যৌক্তিকতা নেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহবায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘৩৪ জনকে নিয়ম লংঘন করে ভর্তি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাধারণ ছাত্রদের দিকে নজর না দিয়ে ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করছে। ছাত্রলীগ কোনো অপকর্ম করলে প্রশাসন তার বিচার করে না। ভিসি ছাত্রলীগের অন্যায়ের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।’ যাদেরকে অবৈধভাবে ছাত্রত্ব দেয়া হয়েছে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল করার দাবি জানান তিনি।
এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি ও ডাকসু নেতা নির্বাচিত হওয়ায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল। সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি, ডাকসুর নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পিতভাবে ছাত্রলীগের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এ খবরের মাধ্যমে সেটা প্রমাণিত হল। আমরা এর সঙ্গে জড়িতদের পদত্যাগ ও ভর্তিকৃতদের বহিষ্কারও চেয়েছি। এ ব্যাপারে যদি কোন পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করব।’
এদিকে সান্ধ্য কোর্সটিকেই অবৈধ দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ ধরণের সান্ধ্য কোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে যায় না। এখন এই অবৈধ কোর্স ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা ধরণের অবৈধ কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। আমরা, আশা করব সিন্ডিকেট এবং সিনেট এই অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সান্ধ্য কোর্স বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি যারা এভাবে ভর্তি হয়েছে তাদের ছাত্রত্বও বাতিল করতে হবে।’
তবে শুধু ছাত্রলীগ নয় ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নও এ সুযোগ নিয়েছে বলে দাবি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সহ সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) সাদ্দাম হোসেন। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে যারা নির্বাচন করেছে তারা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের নিয়মিত শিক্ষার্থী।স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের নিয়মিত শিক্ষার্থীর নিয়ম এবং ইভিনিং এমবিএতে যারা ভর্তি হয় তাদের শিক্ষা পদ্ধতির নিয়ম এক হওয়ার কথা নয়।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৩০ বছর নিয়ম করেছে ডাকসু নির্বাচন করার জন্য। সেক্ষেত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরে উক্তীর্ণ যেকোনো শিক্ষার্থী নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভর্তি করতে পারেন। তবে এই সুযোগ নিয়ে শুধুমাত্র ছাত্রলীগ ভর্তি হয়নি। এই নিয়মের কারণে ছাত্রদল এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরাও এ প্রক্রিয়াতে ভর্তি হয়েছেন।’
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ‘গত ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের সময় উপাচার্যের চিরকুটে ছাত্রলীগের ৩৪ জন নেতার ভর্তি হওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।’
আরো বলা হয়, ‘কতিপয় দৈনিকে দুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগে ‘মাস্টার্স অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট’ প্রোগ্রামে কথিত ‘চিরকুটে ভর্তি’ বিষয়ে প্রকাশিত একটি খবরের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। খবরটির মাধ্যমে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘প্রকৃতপক্ষে উপাচার্য কোন বিভাগ/ইনস্টিটিউট-এ ভর্তির জন্য কোন শিক্ষার্থীকে কোনো ‘চিরকুট’ বা কোনো নির্দেশনা কখনো কাউকে দেননি, দেবার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট নিয়মে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভর্তি কার্যক্রম সম্পাদন করেন। তাই উপাচার্যকে আবর্তন করে অবান্তর, অসত্য, দায়িত্বহীন বক্তব্য ও তথ্য প্রচার না করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হলো।’