০৫ আগস্ট ২০১৯, ১৪:২৪

ঢাবিতে দুই চেয়ারম্যানের ‘অত্যাচারে’ চাকরি ছাড়ছেন কর্মকর্তা

লীনা তাপসী (বামে) ও টুম্পা সমদ্দার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সংগীত বিভাগের সাবেক ও বর্তমান দুই চেয়ারম্যানের নিজেদের ‘পছন্দের প্রার্থীর’ বিপরীতে প্রভাষক পদে আবেদন করায় ‘মানসিক নির্যাতন’ ও হুমকি দিয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন বিভাগেরই একজন কর্মকর্তা ও খণ্ডকালীন শিক্ষক।

ভুক্তভোগী কর্মকর্তার নাম জাকির হোসেন। তিনি সংগীত বিভাগে টানা তিন বছর খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং পরে কর্মকর্তা পদে চাকরি করেন। বিভাগের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. মহসীনা আক্তার খানম (লীনা তাপসী) ও বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দারের ‘অত্যাচারে’ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

জাকির অভিযোগ করেন, লীনা তাপসী ও টুম্পা সমাদ্দার তাকে বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিয়েছেন এবং বিভাগের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছেন। এছাড়া তাকে ফাঁসানোর জন্য ‘অপরিচিত লোকজনের’ মাধ্যমে পকেটে মাদক দ্রব্য রাখা ও ব্যবহৃত মোবাইল ফোন চুরি করার চেষ্টা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

‘মানসিক নির্যাতনের’ শিকার হয়ে সম্প্রতি চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে অব্যাহতি পত্র জমা দেন জাকির হোসেন। অব্যাহতির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে দু’চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বরাবর বিভিন্ন অভিযোগ করেন।

জানা যায়, প্রায় তিন বছর সংগীত বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংগীত বিভাগে ডেমেনস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ পান জাকির হোসেন। ওই নিয়োগ বোর্ডে তৎকালীন কলা অনুষদের ডিন হিসেবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান দায়িত্বরত ছিলেন।

জাকিরের দাবি, ওই পদের বিজ্ঞপ্তির সব শর্ত মেনেই তাকে চাকরি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেট তাকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়। তিনি ডেমেনস্ট্রেটর পদে ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে সংগীত বিভাগে প্রভাষক পদের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে জাকির হোসেন পদটিতে আবেদন করার জন্য চেয়ারম্যানের মাধ্যমে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন।

রেজিস্ট্রার তাকে পদটিতে আবেদন করার অনুমতি দেন। পরে একই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রার বরাবর প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করেন। এরপর সংগীত বিভাগে জাকির হোসেনের আবেদন এবং কাগজপত্র যাচাই করে পদের জন্য তাকে যোগ্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করে।

একই বছরের ২৩ মার্চ উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অফিসে তার সাক্ষাৎকারের জন্য চিঠিও পাঠায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট পদে বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান লীনা তাপসীর পছন্দের প্রার্থী ছিলেন স্বরূপ হোসেন। স্বরূপ হোসেনের বিপরীতে জাকির হোসেন ওই পদে আবদেন করায় লীনা তাপসী তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ জাকিরের।

তার অভিযোগ, পদটিতে আবেদন করার জের ধরে একই বছরের ২০ এপ্রিল লীনা তাপসী তার ডেমনস্ট্রেটর পদে নিয়োগ যথাযথভাবে হয়নি বলে তাকে জানান। একের পর এক নতুন পদ্ধতিতে তার উপর আসতে থাকে নানাধরণের হয়রানি। লীনা তাপসী চাকরি বাঁচাতে তাকে মানববন্ধন করার পরামর্শ দেন।

এদিকে প্রভাষক হিসবে নিয়োগ পেয়ে স্বরূপ হোসেনও এসব নির্যাতনে যোগ দেন। স্বরূপ জাকিরকে চাকরি শেষ হলেও পেনশন পাবেন না, সব টাকা ফেরত দিতে হবে প্রতিনিয়ত এ ধরণের নানা কথা বলে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন জাকির।

জাকির আরও জানান, বিভাগের আরেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বরাজ কুমার দেবের মাধ্যমে জাকির হোসেনের ‘মূল সনদপত্র খামে ভরে’ তৎকালীন চেয়ারম্যান লীনা তাপসীর কাছে জমা দিতে বলেন। এগুলো জমা না দিলে পরে তার সমস্যা হবে, চাকরি করেও পেনশন পাবেন না ইত্যাদি বলে ভয় দেখান। যদিও শিক্ষক বা কর্মকর্তার মূল সদনপত্র চেয়ারম্যানের নিজের কাছে জমা রাখার এখতিয়ার নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর পাঠানো জাকিরের অভিযোগ মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বিভাগ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সমতাপত্র পাওয়ার ১৪ বছর পর পুনর্মূল্যায়নের চিঠি পাঠান। অথচ এ ধরণের চিঠি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হয়ে ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিধি রয়েছে।

জানা যায়, ২০১৭ সালে প্রভাষক পদে জাকির হোসেনের সাথে প্রার্থী হওয়া পংকজ কান্তি দাস বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দারের স্বামী। বিভাগটির ‘শিক্ষক রাজনীতিতে’ লীনা তাপসী ও টুম্পা সামাদ্দার আলাদা গ্রুপের নেতৃত্বে থাকলেও জাকিরের হোসেনের বিষয়ে দুজন একই ধরণের কর্মকান্ডের আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ করেন জাকির।

বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দার গত বছরের ১ জুলাই দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জাকির হোসেনকে একই বিষয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছেন। সর্বশেষ এ বছরের জুন মাসে টুম্পা সমদ্দার জাকির হোসেনকে স্বেচ্ছায় চাকরি না ছাড়লে বরখাস্ত করার হুমকি দেন বলে অভিযোগ করেন জাকির।

জাকির অভিযোগ করেন, বিভাগটিতে জাকিরের একই পদের অন্য এক ডেমোনেস্ট্রেটরকে সপ্তাহে ৫ থেকে ৬টি ক্লাস দেওয়া হলেও জাকিরকে দেওয়া হয়েছে ২০ থেকে ২৪টি ক্লাস। এছাড়া সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী পোস্ট দিয়ে তাকে ফাঁসানোর জন্য কয়েকবার তার মোবাইল ফোন চুরির চেষ্টাও চলে। এরপর থেকে তিনি ক্লাসে আসার সময় মোবাইল আনা বন্ধ করে দেন। তারপর কয়েকবার তার পকেটে মাদকজাতীয় দ্রব্য ডুকিয়ে দিয়ে ও নারী কেলেংকারিতে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিশ্বস্ত সূত্র জানা যায়, জাকির হোসেন হয়রানি ও চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগের বিভিন্ন অনিয়ম, শিক্ষকদের লেখা চুরি এবং বিভাগের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উপাচার্য বরাবর রেজিস্ট্রারের কাছে এ বছরের ১৫ জুলাই অভিযোগ জমা দেন। প্রশাসনিক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা এসব অভিযোগের বিষয়টি টুম্পা সমাদ্দারকে জানান।

তখন টুম্পা সমাদ্দার এবং লীনা তাপসী তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ যেন উপাচার্য পর্যন্ত না পোঁছায় সেজন্য প্রশাসনিক বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তাদের হাতকরার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি বলে জানায় ওই সূত্র।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সংগীত বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান টুম্পা সমাদ্দারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাকির হোসেনকে কোনোরকম হয়রানি করা হয়নি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগে অনেক শিক্ষকেরই বসার কক্ষ নাই তারও ছিল না। সে কেন চলে গেছে তা আমি জানি না। তাকে নিয়ে আসার জন্য আমাদের কয়েকজন শিক্ষক তার বাড়িতে গিয়েছে, তার মোবাইলে বারবার ফোন দেয়া হয়েছে কিন্তু সে ধরেনি। আমরা বিভাগ থেকে ইউজিসিতে কোন পত্র দেইনি। সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমেই নিয়মানুযায়ী হয়েছে। যেহেতু সে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিয়েছে বাকিটা তারা দেখবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক চেয়ারম্যান ড. লীনা তাপসী প্রতিবেদককে বলেন,‘তোমরা খোঁজ নিলে জানবে তার মাস্টার্স নেই। সে ভারত থেকে একটা ডিপ্লোমা করেছে। তাকে আমরা বারবার এটা করতে বলেছি সে করেনি। তার সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে কারণ এসব বিষয় বিভাগ দেখে। আর সে এমফিল করতে চেয়েছিল। তাই সার্টিফিকেট চেয়েছিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ওকে সেভ করতে চেয়েছি। ওর চাকরি খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে প্রথম থেকেই আমরা ওর পিছনে লাগতাম। কিন্তু আমাদের কোনো ইচ্ছে নেই। চাকরি হয়ে গেছে, ও করুক।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এখনো অভিযোগের বিষয়ে জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ‘এগুলো খুবই গুরুতর অভিযোগ। আমার কাছে পৌঁছালে আমি দেখব। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী এগুলোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’