৩৫ বাস্তবায়নে অনীহার দায় নিতে হবে
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। কখনো ক্ষমা করবেও না। লক্ষ কোটি তরুণের রিজিক রুজির পথ রুদ্ধ করার দায় আপনারা কেউ কোনোদিন এড়াতে পারবেন না। তাদের ভবিষ্যৎ সার্টিফিকেটের বয়সের ঘেরাটোপে বন্দি করে রাখার খেসারত অবশ্যই দিতে হবে।।তরুণদের অভিশাপ একদিন আপনাদেরও ছোঁয়াছে সংক্রমণে আক্রান্ত করবে।
নিয়তির খেলা বড়ই নিষ্ঠুর ও নির্মম। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড্ড হিংসুটে তবে এর সম প্রতিক্রিয়া আছে।যার চেতনা ও আদর্শের দোহাই দিয়ে রাজনীতি করি সেই মানুষটির বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষাকে অবলীলায় এড়িয়ে যাচ্ছি কখনো কখনো স্বেচ্ছাচারী হয়ে পদদলিত করছি। যা খুবই দুঃখজনক ও কষ্টের। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন 'যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও, সে একজনও যদি হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।” বিগত ছয় বছরে ৩৫ এর আন্দোলনকারীরা এমন কোনো শান্তিপূর্ণ পথ নেই যা অবলম্বন করে তারা এগিয়ে যায়নি।
কখনো শক্তি প্রয়োগ করে সরকারি বেসরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেনি ।তারা সরকারি ও বিরোধী দলের অসংখ্য নেতার সঙ্গে যৌক্তিক দাবি ও আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছে। কিন্তু এটা তো বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ভাষাকে দুর্বলতা মনে করা হয়। সহিংসতা অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার কর্মসূচী নিয়ে রাজপথ কাঁপালে তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ত। কারণ বাঙালির রক্তে মাংসে মিশে আছে মিছিলে ফেস্টুনে শ্লোগানে উত্তপ্ত রাজপথ। তারপর আলোচনার টেবিলে সমস্যা উত্তরণে দফায় দফায় মিটিং ও দাবি মানার সংকেত ।
সমস্যা উদ্ভব হবার আগে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা নিরসনে এ জাতির প্রচন্ড অনীহা। রক্তপাত জীবনহানি, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের পরেই আমাদের আলোচনার পথ তৈরি হয়। শুভ বুদ্ধির উদয় হয়।সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ এর দাবিতে তারুণ্যের ব্যাপক অংশগ্রহণের এ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কখনো অবজ্ঞা করবেন না। বুড়োদের আন্দোলন বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন না। এ বয়সে কেউ চাকরি পাবে না বলে দয়া করে মশকরা করবেন না। তাদের সুযোগ দিন । অবাস্তব, অযৌক্তিক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে তাদের দাবিকে দমিয়ে রাখবেন না। তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হলে প্লিজ নোংরা রাজনীতি করার উপদেশ দেবেন না।
কারণ এসব তরুণ সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করতে পারবে না। মাত্র পনরো দিনে শেয়ার বাজারের ২৭হাজার কোটি টাকা লোপাট করতে পারবে না। হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হতে এরা জানে না। তাদের শুধু সনদের বয়স ৩৫ বছর করে চাকরি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিন। তারা সুযোগ পেলে দেশটাকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে যাবে। উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্নের সারথি হবে।তাদের যদি সুযোগ না দেন তাহলে তাদের ক্ষোভ আর কষ্টের অনলে দগ্ধ হয়ে, না পাবার যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করতে হবে। সেই যাপিত জীবন হবে বড়ই কষ্টের বড়ই অভিমানের। হয়তো কেউ বিপথগামী হয়ে তিউনিসিয়ার সেই বুয়াজিদ হতে পারে। যার আত্মাহুতিতে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য নড়ে চড়ে বসেছিল। স্বৈরশাসকের গদিতে কম্পন তুলেছিল। যে কম্পনের প্রতিক্রিয়ায় অনেক শাসককে মসনদ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।
তারুণ্যের শক্তির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। তবে ভয়ের কারণ নেই । অদূর ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা এদেশে সংঘটিত হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এখন এদেশের জনগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, হানাদার পাক বাহিনীকে হটানোর আন্দোলন, স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের আন্দোলন ও বিভিন্ন সময়ে স্বৈরশাসনের মূলোৎপাটনের পর এ জাতি বড্ড ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত। তাই জাতি এখন শ্রান্তির ঘুমে নিমগ্ন।
এদেশের যুবা তরুণদের নির্বাক নিরুদ্বেগ নিস্তব্ধতা দেখে মনে হলো কুরআনের সেই আসহাবে কাহাফের কয়েকজন যুবকের কথা। যারা প্রায় তিনশ বছর একটি গুহায় তন্দ্রায় তন্ময় ছিল। বাংলাদেশের যে কয়জন যুবক এখনো জেগে আছে, অধিকার আদায়ে তৎপর ও অগ্রগামী তারা হয়তো ব্যাকআপ কিংবা পিঠ বাঁচিয়ে টিকে আছে। তাদের জন্য একটা ছোট গল্প মনে পড়ে গেল। একদিন ঢাকি রাজ্য জুড়ে ঢোল পিটিয়ে রাজ্যের সব বিবাহিত পুরুষদের রাজ প্রাসাদের সামনে হাজির হতে বললেন। নির্ধারিত দিনে সব বিবাহিত পুরুষ হাজির। রাজা ঘোষণা দিলেন যারা স্ত্রীর কথা শোনো তারা ডান পাশে দাঁড়াও। যারা স্ত্রীর কথা শোনো না তারা বাম পাশে দাঁড়াও। রাজার ঘোষণা অনুযায়ী সবাই ডান পাশে দাঁড়ালো শুধু একজন বাম পাশে দাড়ালো।
ফলাফল নিশ্চয়ই পেয়ে গেলেন যে রাজ্যের সব পুরুষই কমবেশি স্ত্রীর কথা শোনে। একজন শুধু বীরপুরুষ ছিল যে স্ত্রীর কথা শুনতো না। ঘটনা তো এমনই হবার কথা। রাজা সাহসী সেই বীরপুরুষকে অভিনন্দিত করল এবং বলল যে তুমিই আমার রাজ্যের একমাত্র বীর পুরুষ যে স্ত্রীর কথা শোনে না। লোকটি বলল মহারাজ আমি বীরপুরুষ এবং স্ত্রীর কথা শুনি কী না জানি না। তবে এখানে আসার সময় আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল বেশি সংখ্যক মানুষ যেদিকে দাঁড়াবে সেদিকে আমি যেন না দাঁড়ায়। গল্প পড়ে হয়তো এখন হাসতে শুরু করেছেন। আমি চিন্তার খোরাক দিয়েছি হাসির নয়।
সবারই কমবেশি পিছুটান আছে, সংসার আছে, মায়ার জগত আছে। যখন আন্দোলন সংগ্রামে থাকে কখনো মুখের সামনে ভেসে উঠে মায়ের স্নেহ ভরা মুখ, প্রিয়তমার গালে টোল পড়া হাসি, ছোট বোনের ভাইয়া ডাকের মধুর কল্পনা। এসবই আন্দোলনর পিছুটান। জীবনবাজি রেখে লড়লে সত্যে অটল থাকলে কোনো পিছুটান তারুণ্যেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। মনে রাখতে হবে মায়ের মুখে হাসি, প্রিয়তমার জন্য স্বপ্নের জগত উপহার দেওয়া, ছোট বোনের আবদার পূরণে সুন্দর পরিবেশ তৈরিই এ আন্দোলন। কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে কিংবা পরামর্শে নয়। নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আন্দোলন সংগ্রাম করতে গেলে সাহসী হতে হয়। হিম্মত থাকতে হয়। কখনো তোষামোদ ও তেল মর্দন করে দাবি আদায় হয় না। কোন দলের নামে ও নেতার ছবি বুকে পিঠে বেঁধে গোটা বাংলাদেশ হাজার বার চক্কর দিয়েও দাবি আদায় হবে না। যদি না থাকে সৎ সাহস দক্ষ, আপোষহীন নেতৃত্ব । উপরের গল্পের সাথে আমাদের অনেকের চরিত্র মিলে যায়। সারাদিন গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়ে রাতে গিয়ে পা ধরে লুটে পড়ি। তেল মর্দন করি। কেউ যদি গল্পের মতো একজনেও সাহস করে রাজপথে দাঁড়িয়ে যায় তার পেছনেও থাকে করো না কারো ইন্ধন। কারো প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আন্দোলন চলতে পারে কিন্তু গতি আসে না।
এতে করে আন্দোলনের গতি প্রকৃতি উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। একটি আন্দোলন সফল করতে দৃঢ় অটল ও বিশ্বস্ত নেতৃত্ব পরিশ্রমী নিবেদিত কর্মী বাহিনী বেশি প্রয়োজন।তবেই দাবি পূরণ হবে এবং সফলতা একদিন হাতের মুঠোয় ধরা দেবে।আন্দোলনে থাকবে স্বতঃস্ফূর্ততা ও দাবি আদায়ে একনিষ্ঠ মন। মনে রাখতে হবে দেশটি আমাদের এবং ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাজপথ কম্পিত, শ্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করার অধিকারও আমাদের আছে। অবশ্যই তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হতে হবে কারো বশংবদ না হয়ে। তেল মর্দন ছাড়া।
চলতি বছরে সংসদে চাকরিতে বয়স ৩৫ করার প্রস্তাবটি নাকচ হবার পর যারপরনাই হতাশ হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি। কিভাবে জন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে কয়েক মিনিটে মামুলিভাবে গলাটিপে হত্যা করলো। প্রস্তাবটি নাকচ করতে যেসব যুক্তির অবতারণা করা হলো সেগুলো অতি সাধারণ এবং অসার যুক্তিতে পূর্ণ ।এরপরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীলদের একই যুক্তি বারবার শ্রবণে কান ঝালাপালা। কিন্তু এসব বক্তব্যে শুধু যুক্তির অপব্যবহারই হয়েছে অকাট্য যুক্তি অনুপস্থিত থেকেছে। তীক্ষ্ণ,শক্তিশালী কোনো যুক্তির ছিটেফোঁটা এতে ছিল না।
শেষ করি একটা গল্প দিয়ে। যে গল্পটি ফেসবুকে কয়েকদিন ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।গাধা আর শিয়ালের গল্প আমরা কমবেশি সকলেই জানি। গাধা আর শিয়াল বাদানুবাদ, তর্ক করছিল মাঠের ঘাসের রং নিয়ে। গাধা বলল ঘাস হলুদ।শিয়াল বলে উঠল ঘাস সবুজ। সারাদিন গাধা এবং শিয়াল দুজনে তর্ক করল। গাধা তো কিছুতেই হার মানতে রাজি না। তারা দুজনে শেষ পর্যন্ত সিংহের কাছে গেল বিচার নিয়ে। সিংহ সব শুনে গাধাকে মুক্তি দিলো ও শিয়ালকে জেল জরিমানা করল। শিয়াল তখন বলেছিল "সিংহ রাজা, ঘাসের রং কি সবুজ নয়?" সিংহ উত্তরে জানালো, "ঘাস অবশ্যই সবুজ। আমি তোকে সেই জন্যে তো জেল দেইনি। তোকে জেল দিয়েছি এই জন্যে যে তুই গাধার সাথে তর্ক করেছিস কেন?
আজকের ৩৫ এর আন্দোলন নিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কি যুক্তি উপস্থাপন করবেন? কাকে যুক্তি দেখাতে যাবেন। অগত্যে শিয়ালের ন্যায় সঠিক জিনিসকে সঠিক বলার কারণে হামলা মামলা হয়রানির শিকার হতে হবে।তর্ক তো যার তার সঙ্গে করা যায় না। যে তর্ক বোঝে, যুক্তি বোঝে তার সঙ্গে যুক্তি দিয়ে কথা চলে।নচেৎ সবকিছু অরণ্যে রোদন হয়ে যায়।আজ বড্ড বেশি মনে পড়ছে - জীবনানন্দ দাশের অদ্ভুত আঁধার এক কবিতাটি,
"অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই - প্রীতি নেই - করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।"
তবে আমি হতাশ নই । আশাবাদী ৩৫ এর দাবি একদিন আলোর মুখ দেখবে। আজ না হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ৩৫ এর ফলাফল ঘরে তুলবে। আজ যারা ৩৫ এর দাবির সঙ্গে একমত নয় তাদের এতটুকু বলবো একদিন আফসোস করতে হবে। ৩৫ এর জয় হোক। তারুণ্যের শক্তি উন্মোচিত করুক নব দিগন্তের আশার প্রদীপ। নিরন্তর শুভ কামনা আজকের দিনে ন্যায্য দাবি আদায়ের রাজপথের লড়াকু অকুতোভয় তারুণ্যের শক্তির।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক