২০ জুলাই ২০১৯, ২৩:২৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী পেল সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা?

দেলোয়ার, মামুন এবং মমিনুল ইসলাম দ্বীপ জেলা ভোলার এই তিন বন্ধু ২০১১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। দেলোয়ার ও মামুন স্নাতকের জন্য ভর্তি হন ভোলা সরকারি কলেজে। আর মানসম্পন্ন শিক্ষা ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায় ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন মমিনুল। তবে তার বন্ধুরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজ থেকে অনার্স মাস্টাস শেষে করলেও মমিনুল এখনো অনার্সের গন্ডি পার হতে পারেননি।

অন্যদিকে, ২০১৭ সালে একই সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আব্দুল মাজেদ ও শান্ত ইসলাম। এরপর মাজেদ ভর্তি হন লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে; যেটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত। অন্যদিকে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন শান্ত।

বন্ধু মাজেদ ইসলাম প্রথম বর্ষের পরীক্ষা এবং রেজাল্ট নিয়ে এখন দ্বিতীয় বর্ষ শেষে করতে যাচ্ছেন। অথচ সাত কলেজভুক্ত তিতুমীর কলেজের ছাত্র শান্ত এখনো জানেন না— কবে তার ১ম বর্ষের রেজাল্ট হবে।

শুধু মমিনুল আর শান্তই নয়, রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এবং প্রধান কলেজগুলোর প্রায় সব শিক্ষার্থীর একই দশা। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের বন্ধুরা যখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলেয়ে শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ধাপ পার করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন; তখন ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বাংলা কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই সাতটি কলেজের ছাত্ররা শিক্ষাজটে আটকা পড়ে হতাশায় দিন গুণছেন।

সম্প্রতি এই হতাশার বলি হয়েছেন ঢাবি অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের মনিজা আক্তার মিতু নামে এক ছাত্রী। ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের এই ছাত্রী তার প্রথম বর্ষে পরীক্ষায় তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হন। বিষয়টি জানার পর হতাশার ভার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন মিতু।

সেশনজট কমিয়ে রাজধানীর বড় এই কলেজগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন ত্বরান্বিত করার জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তুলে দেয়া হয়। কিন্তু সে লক্ষ্য হাসিল হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কলেজ এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে আছে এই সাত কলেজে।

কার প্রয়োজনে অধিভুক্ত হলো সাত কলেজ?
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের আগ পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় পরিচালিত হতো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজসহ দুই হাজারেরও বেশি কলেজ। ওই সময় এসব কলেজে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২১ লাখ।

তবে ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ কমাতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন। কিন্তু এরই মধ্যে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’র মাধ্যমে সেশনজট কমিয়ে আনেন। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন কারণে সরকারি কলেজগুলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার কাজের গতি কমে যায়।

পরে সরকারের উচ্চমহলের একটি সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এই সাতটি কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আদাল হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। যদিও এর পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের বড় ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্রের তথ্য, ওই সময় আরেফিন সিদ্দিক এবং অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদের মধ্যে ব্যক্তি দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। তাই অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ উপর প্রতিশোধ নিতে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নেন আরেফিন সিদ্দিক। এতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের উৎস কমে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

কী পেলো সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা?
শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সংস্কারের জন্য সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত করা হয়েছে বলে বলা হয়ে থাকে। দুই বছর আগে যখন এই সীদ্ধান্ত হয় তখন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরাও আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়। দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যায়ের সিলেবাসের তারা লেখাপড়া করবে এবং ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ পাবেন এমন আশায় উদ্যোমী হয়।

কিন্তু বাস্তবে তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি, শুধুমাত্র রাস্তায় আন্দোলন ও প্রচারণা ছাড়া। আগের মতোই ছাত্ররা ভর্তি হওয়ার পর আর তাদের কোন খোঁজ মেলে না। ক্লাস, এসাইনমেন্ট কোন কিছুই তারা নেই। আবার ছাত্র ছাত্রী এলেও শিক্ষক খুজে পাওয়া যায় না। শিক্ষক সংকট, ক্লাস রুমের অভাব যে ভাবে ছিল সেভাবেই চলতে থাকে কলেজের কার্যক্রম।

তবে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবরতন আসে। আগে কলেজ শিক্ষকরা খাতা মূল্যায়ন করলেও অধিভুক্ত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এসব কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা দেখা শুরু করেন। যা শিক্ষার্থদের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষের অনাস চুড়ান্ত পরীক্ষা নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওই পরীক্ষায় সাত কলেজের প্রায় ৯০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী ফেল করে।

অধিকাংশ শিক্ষার্থী ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা জমানাতে ওই পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের আবেদন করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টাকা নিয়ে খাতা মূল্যায়ন না করেই পরের সেশনের সঙ্গে মান উন্নয়ন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে। যা গত ফেব্রেুয়ারিতে শেষ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরনের নীতিকে হঠকারিতা বলে দাবি শিক্ষার্থীদের। তারা জানান, সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার খাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়ন করা আর খেজুর গাছ লাগিয়ে আঙ্গুর ফল প্রত্যাশা একই কথা। কারণ এসব কলেজে ক্লাস নেন কলেজ শিক্ষকরা। তারপরেও যদি নিয়মিত ক্লাস হতে তাতেও কোন আপত্তি থাকতো না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন ভিন্ন কথা। কলেজগুলোর একাডেমিক কার্যক্রম সংস্কারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সাত কলেজের মুখপাত্র মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ বলেন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরির করা হচ্ছে, যা পুরোপুরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত হবে। এছাড়া শিক্ষক সংকট বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। কলেজগুলোর কাছ থেকে তালিকা চাওয়া হচ্ছে। তালিকা পেলে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। শিক্ষকরা এখন নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন, ছাত্ররা নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে। নিজ নিজ কলেজের অধ্যক্ষরা ক্লাস এবং পরীক্ষার বিষয়গুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করনে বলে জানান।

ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর নেহাল আহমেদও একই অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমাদের কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদারকি করছে। যে কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা আগের চেয়ে এখন ক্লাসমুখী। সাত কলেজের প্রায় প্রত্যেকটি প্রচন্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হয়েছে; কিন্তু আবকাঠামো এবং শিক্ষক সংকট বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।