নির্মমতার একটি বছর!

  © সংগৃহীত

গতবছরের আজকের এই দিনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে ছাত্রলীগের কতিপয় সন্ত্রাসী ঝাপিয়ে পরেছিল কোটা সংষ্কারের দবীতে আন্দোলনরতদের উপর। সেদিন বাংলাদেশ সাধারণ ছা্ত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ‍যুগ্ন আহবায়ক ফারুক সহ অনেককেই নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করার অসংখ্য ভিডিওচিত্র বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। আজ আমরা সেই হামলায় আহত ফারুকের মুখেই সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনবো।

২০১৮ সালের ৩০ জুন প্রজ্ঞাপনের দাবিতে আমাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল সংবাদ সম্মেলন, আর স্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি প্রাঙ্গণ। সেদিন সকালে আমি নুরুল হক নুর ও হাসান আল মামুন তিন সহযোদ্ধা ঢাবির ভিসি চত্বরে একত্রিত হয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির দিকে রওয়ানা দেই। এরই মাঝে আমাদের কানে খবর আসে, সেখানে সকাল থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে আছে। আমরা তিন জন পায়ে হেঁটেই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গেলাম। গিয়েই দেখি ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর জটলা। আমরা গেইট বরাবর পৌছানোর সাথে সাথেই ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মী হায়েনার মতো আমাদের উপর ঝাপিয়ে পরে। রক্তাক্ত হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র শিক্ষাঙ্গণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আমার সহযোদ্ধা বর্তমান ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর ও আহবায়ক হাসান আল মামুন গুরুতর আহত হয়। নুরুল হক নুরকে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির প্রধান জাবেদ স্যার জাপটে না ধরলে সন্ত্রাসীরা তাকে মেরেই ফেলত। তার অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয় নুরকে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বলে উপরের নির্দেশে আপনাদের এখানে রাখা যাবে না। আমাদের ঢাকা মেডিকেল থেকে বের করে দেয়। আমরা দ্রুত নুরকে নিয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি মেডিকেলে যায় এবং সেখানেও তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয় নি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম সেখানেও নাকি চিকিৎসা দিতে নিষেধ করেছে উপর মহল। এই ছিল তখনকার পরিস্থিতি।

০১ জুলাই সহযোদ্ধা রাশেদ খান ও মাহফুজকে কে ডিবি পুলিশ আটক করে (এটি ছিল গুম করার মতো একটি ঘটনা)।
আমি এবং মামুন সেদিন রাতেই নুরুল হক নুরের সাথে হাসপাতালে বসেই ফেইসবুক লাইভে আসি এবং কর্মসূচি ঘোষণা করি, আগামী ২ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল পালন করা হবে।

আমরা এই দুইদিন মোহাম্মদপুরে এক সহযোদ্ধার বাসায় ছিলাম। ২ জুলাই, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম আমরা। সমগ্র দেশে একটা ভয়ের আতঙ্ক বিরাজ করতেছে। মানুষজন ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না এমন একটা অবস্থা সমগ্র দেশে তৈরি হয়েছিল। আমরা নাস্তা করেই বেরিয়ে পরলাম, আর সবাইকে জানিয়ে দিলাম কেন্দ্রীয় শহীদমিনার থেকে আমরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবো।

সম্ভবত সকাল ১০ টার দিকে আমরা তিনজন কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে পৌছালাম সিএনজিতে করে। সেখানে পৌছায়েই দেখি অনেক সাংবাদিক হাজির হয়েছে আমাদের আগেই কিন্তু আমাদের নেতাকর্মীর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। বোধহয় ২০-২৫ জন হবে, তবে আমাদের আশপাশে অনেক মানুষ ছিল যারা প্রোগ্রাম শুরু হলে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করতো।

আমরা সেখানে গিয়েই, আমি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেছিলাম এরই মাঝে ছাত্রলীগের বিশাল একটি মোটরসাইকেল বহর এসে থামল শহীদমিনারের পাদদেশে। অনেকে আমাকে তখন বলল ভাই দৌড় দেন এখান থেকে, আর এক মিনিট এখানে থাকলে আপনাদের হাড় হাড্ডি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি বললাম আজকে মারা গেলেও এখান থেকে এক পা পিছপা হবো না। মরবো তবুও শহীদমিনার থেকে যাবো না। এই কথা বলতে বলতেই সন্ত্রাসীরা আমার উপর জঙ্গলের হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পরে। আমি কোনমতে নিজের মাথাটা সেভ রাখার চেষ্টা করি দুই হাত দিয়ে। এরইমাঝে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে পবিত্র শহীদমিনার প্রাঙ্গণ। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সেখানে আমার অনেক সহযোদ্ধাকে তারা মারাত্মকভাবে জখম করে।

শুধু তাই নয়, আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে মরিয়ম মান্নান নামে এক ছোটবোন। সন্ত্রাসীরা তাকেও আইয়ামে জাহেলি যুগের মতো লাঞ্ছিত করে (যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়)। সেই সাথে আমাদের আরও অনেক নারী সহযোদ্ধাকে তারা জখম ও লাঞ্ছিত করে।

আমার যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি নিজেকে রাজধানীর হোলিফ্যামিলি হাসপাতালে আবিষ্কার করি। আমার সমগ্র শরীর ফুলে ওঠেছে, এক চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এরই মাঝে টেলিভিশনে চোখ পরলে (আমি তখন ক্যাবিনে, সেখানে টিভি থাকায় আমি আমার উপর হামালার খবর সহ দেশের বিভিন্ন জায়গার হামলার খবর দেখতে থাকি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরিকুলের ঘটনাটি মারাত্মকভাবে নাড়া দেই আমাকে। সন্ত্রাসীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমাদের সহযোদ্ধা তরিকুলকে হাতুড়ি পেটা করে জখম করে ফেলে রেখে যায়। তার পায়ের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, এটি দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে থাকে অঝোর ধারায়। এসব চিত্র দেখি আর ভাবি, পাকিস্তানীরাও এভাবে আমাদের উপর ঝাপিয়ে পরেছিল কিনা সন্দেহ।

এদিকে আমার পরিবার আমার কোন খোঁজ না পেয়ে পাগল প্রায় হয়ে গেছিল। আমার গর্ভধারিনী মা মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল টানা ২ মাস।

[চলমান থাকবে, আসছে ঘটনা প্রবাহ-২]

 

লেখক: যুগ্ম-আহবায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।


সর্বশেষ সংবাদ