৩০ জুন ২০১৯, ১৫:১৫

ঢাবির ছেলে-মেয়েরা প্রক্টরের অনুমতিতে ৫ মিনিট কথা বলতে পারতেন

  © ফা্ইল ফটো

হাজারো ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম আর সাফল্যের চিরচেনা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ বছর পূর্ণ হল। প্রথাগত ভাবনার বাইরে দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতি গঠনে যে বিশ্ববিদ্যালয় লড়ে যাচ্ছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ দিবসটি নানা আয়োজনে পালিত হতে যাচ্ছে। বিজ্ঞানী সত্যেন বোস, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং গণিতের তুখোড় শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ইতিহাসবেত্তা মোহর আলী ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো কৃতীজনেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের মতো ‘মাস্টোর’রা জ্ঞানে, আনন্দে, জাতি গঠনে নিজেদের নিবেদন করেছিলেন বলে আজো এ ক্যাম্পাস জাতির অহঙ্কারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যার ভূমিকা তুলনারহিত, তিনি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। অথচ তার মূল্যায়ন এখন যৎসামান্যই হতে দেখা যায়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ বছর পর এসে আজ অনেকেই হিসেবের খাতায়, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে ব্যস্ত।

গৌরবের ক্যাম্পাসে এবার যুক্ত হয়েছে নতুন পালক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) দীর্ঘ ২৮ বছর পর নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে। সিনেট পেয়েছে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি। অবশ্য ডাকসু নির্বাচন এবং ছাত্র প্রতিনিধি বাছাই নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এ নিয়ে সংঘর্ষ, হামলা-মামলা, রাজনৈতিক খেল অনেক কিছুই হয়েছে। এ উপলক্ষে ছাত্রদলও দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ পেয়েছে, এখনো আছে। সবমিলিয়ে অনেকেই একটু সন্তোষ খোঁজেন- হাজারো না পাওয়ার ভিড়ে কিছু হলেও তো মিলেছে।

ক্যাম্পাসের কার্জন হল থেকে অপরাজেয় বাংলা, টিএসসি থেকে মল চত্বর, পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে নানা স্মৃতি রেখে গেছেন পুরনোরা। এখনো রাখছেন। নতুনেরা আসছেন, মুখর করে তুলছেন প্রিয় ক্যাম্পাস। ১৯২১ সালে সেই সময়কার পূর্ব বাংলার ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে এর বিকাশ। বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ঘিরে আজ বর্ণিল ক্যাম্পাসে পুরনো-নতুন শিক্ষার্থীরা মেতে উঠবেন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। পুরনোরা স্মৃতিচারণ করবেন, নতুনেরা জানবেন গৌরবময় অতীত।

ফুলেল শোভা, শ্যামলছায়ায় ঢেকে থাকা প্রিয় ক্যাম্পাস কারো কাছে স্মৃতি। কারো কাছে বর্তমান। তবে সবার চোখে উজ্জ্বল। মধুর ক্যান্টিন, হাকিম ভাইয়ের চায়ের দোকান ঘিরে আড্ডা কিংবা ছাত্রী হলের সামনে জটলা করে পার করা দিনের কথা মনে আছে অনেকের। সেই আড্ডার পরিধি এখন বেড়েছে। লাইব্রেরিতে আগে বেশি ছিল পড়ুয়ারা। এখন কম, চাকরির পড়া নিয়েই ব্যস্ততা বেশি সবার। চায়ের কাপে ঝড় তোলা আড্ডাটা এখানে বৃথায় সময় নষ্ট নয়। এ কথা সবার জানা।

শিক্ষার্থীদের এখনো হাজারো সমস্যা। সবার জন্য আবাসন নেই। হলে ছাত্র রাজনীতির কর্তৃত্ব। খাবারের মান দিন দিন যেন খারাপই হচ্ছে। ক্লাসরুমের অভাব। লাইব্রেরীতে সিট মেলেনা। সান্ধ্যকালীন কোর্স আর সাত কলেজ নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই। শিক্ষার মান নিয়ে তো বলার মতো তেমন কিছু নেই বললেই চলে। র‌্যাংকিং নিয়ে এ বছর একরাশ বিতর্ক হয়ে গেছে। ভালো গবেষণা মেলে কালেভদ্রে। অনেক শিক্ষকের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতেই আগ্রহ বেশি। সমস্যার শেষ নেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তেমনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পীঠভূমি। মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছে। বটতলা, অপরাজেয় বাংলা, ডাকসু, কলাভবন চত্বর ঘিরে সেই সময়কার বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল, এখনো তেমন আছে। টিএসসিকে অতীতে সংস্কৃতি চর্চার তীর্থভূমি বলা হলেও এখন তা কতটা হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। অথচ প্রিয় ক্যাম্পাসে গুলির শব্দের চেয়ে বেশি ছিল সংস্কৃতির শক্তি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপক সুনাম অর্জন করে সারা বিশ্বে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা বলেছিলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপমা বিশ্বে কেবল এ বিশ্ববিদ্যালয়ই হতে পারে। অন্য কারো সাথে এর তুলনা হয় না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে কখনো বিশ্বে এত বড় অর্জন হয়নি কোনো দেশের।’

মেধার ক্যাম্পাসে অতীতে ছাত্র রাজনীতির ঘাড়ে চেপে এসেছে অস্ত্র। ক্যাম্পাসে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। গুলির শব্দও শোনা গেছে। ককটেল বিস্ফোরণও হয়েছে। তবে এটি ধীরে ধীরে কমে আসছে, এটিই আশার কথা।

প্রেম-অপ্রেম ছিল ক্যাম্পাসে। ছাত্র রাজনীতি ও আধিপত্যবাদ ক্যাম্পাসের ললাটে দিয়ে গেছেন প্রায় ৯০টি হত্যাকাণ্ডের কলঙ্ক তিলক। আবার এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শান্তির জন্য নোবেল জিতেছেন। ড. ইউনূসের কথায় ‘আমাদের ক্যাম্পাসে গৌরব ক্ষণিকের জন্য মলিন হয়েছে ঠিকই। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। মেঘ আসবে। তাই বলে নক্ষত্র ঢেকে থাকবে না। তাই হয়েছে।’

মরহুম জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে- ‘কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে তার পাশের একটি কক্ষে ৫ মিনিট কথা বলা যেত’। এর মধ্যেও প্রেম হতো বলে জানিয়েছেন তিনি। তখনো ক্যাম্পাসে রাজনীতি ঢোকেনি। পাকিস্তানি শাসকেরা ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিয়ে আসেন। সাথে নিয়ে আসে অস্ত্র। ছাত্ররা ধীরে ধীরে আরেকটা পরিচয় ধারণ করেন। ‘ক্যাডার’। ‘ক্যাডারদের’ সবাই ভয় পান। সেই ক্যাডারের চর্চা এখনো জারি রেখেছে আমাদের ছাত্র রাজনীতি।

বিশ্ববিদ্যালয় এখন ছোট নেই। ৪০ হাজারের মতো শিক্ষার্থী পড়ছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিদিন খবর হয় গণমাধ্যমে। ছাত্র রাজনীতির রাজধানী এ ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের তৎপরতা আছে। আর সে সুবাদে আছে গ্রুপিং। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে। খুন, যখন-তখন হল বন্ধ ঘোষণা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।পুরনোদের স্মৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে জৌলুস কম ছিল। কিন্তু ভালো ফল ছিল। দলবাজি কম ছিল।

দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ ও প্রথম শ্রেণী প্রদানও কম ছিল। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছিল মেধাবীদের শিক্ষকদের জায়গা। কিন্তু এখন সেটি নেই। ‘তেল’ এখানে প্রথম হওয়া ও শিক্ষক হওয়ার অন্যতম শর্ত! এছাড়া অনেক শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দুরত্ব বেড়েছে অনেক। কারণ প্রায়শই বেফাঁস মন্তব্য আসে দুপক্ষ থেকেই। রাজনীতিও এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম বাঁধা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন প্রবীণ অধ্যাপক বলেছিলেন, আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ শতাংশ শিক্ষক ছিলেন মেধাবী। এখন ২০ শতাংশে ঠেকেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ছিল সংস্কৃতির কেন্দ্র। এ কথা কবুল করতে কারো সঙ্কোচ নেই। আসকার ইবনে শাইখ, ফেরদৌসী মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো খ্যাতিমানেরা এখান থেকে বেরিয়েছেন। সেই ঐতিহ্য মলিন। দেশের সব নেতৃত্বের জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পুরনোরা এখনো ক্যাম্পাসে আসেন। আড্ডায় মাতেন।

স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ ছাত্রলীগ ছিল কর্তৃত্ববাদী। এখন তাদের সেটা ইতিহাস। বর্তমানের ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল আছে; ক্যাম্পাসে। নতুন শিক্ষার্থীদের চোখে নতুন আধিপত্যবাদের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। তবে বড় পটপরিবর্তনটা এনেছিল ছাত্রদল। ২০০২ সাল থেকে এ পরিবর্তন হয় সনি হত্যাকাণ্ডের পর। অস্ত্রের রাজনীতি প্রায় বিদায় নিয়েছিল সেই সময়। পাহারায় বসতে হতো না হলে নতুন ওঠা শিক্ষার্থীদের। রাইফেলের বাঁট ধরে নির্ঘুম রাতও পার করতে হতো না কারো। আগে হতো।

ছাত্রলীগ আমলের ১৯৯৯ সালে হলে থাকা শিক্ষার্থী হাসানের মতে, হলে ওঠার পর দুর্বিষহ জীবন কেটেছে। ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব। মিছিলে যাওয়ার আগে হাজিরা ডাকা হতো। আবার মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে। পথে যেন কেউ পালাতে না পারে। ছাত্রদল বলে কোনো অস্তিত্ব ছিল না হলে। এখনো ছাত্রদল হলের বাইরে, তবে ক্যাম্পাসে আছে। ছাত্রলীগ একক কর্তৃত্বে রেখেছে ক্যাম্পাস ও হল।