আমি যে কারনে আড়ং বর্জন করবো না
রাজধানীর উত্তরায় অভিযান চালিয়ে আড়ংকে জরিমানা করায় গতকাল এক কর্মকর্তাকে বদলীর আদেশ দেওয়া হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এটার তীব্র প্রতিবাদ জানালে টনক নড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। ওই কর্মকর্তার বদলির আদেশ স্থগিত করে তাঁরা।
ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে আড়ং পন্য বর্জনের ডাক দেয় নেটিজেনরা। কিন্ত আড়ং পন্য বর্জনের পক্ষে নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আড়ং পন্য বর্জন না করার পিছনে কিছু কারন তুলে ধরেছেন। পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল-
আড়ং-কে বর্জন করবো না আমি
উত্তরার আড়ং ভুলে বা সজ্ঞানে একটা ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবীর দাম কয়েক শত টাকা বেশী রেখেছিল। আমি বিশ্বাস করিনা আড়ং-এর কেউ বেশী লাভের আশায় জেনেবুছে শুধু একটা কাপড়ের দামে এমন হেরফের করেছিল। তারপরও যদি আড়ং-এর কেউ এটা করে থাকে তাহলে সাড়ে চার লক্ষ টাকা জরিমানা তো যথেষ্ট। এজন্য আড়ং কে বর্জন করার ডাক দেয়ার মানে কি?
কেউ কেউ অবশ্য বিশ্বাস করেছেন যে আড়ং-এর কারণে জরিমানাকারী শাহরিয়ার সাহেবের বদলীর আদেশ হয়েছিল। কিন্তু এটা সত্যি কিনা আমরা জানি না। আরো যে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানদের বিরুদ্ধে শাহরিয়ার সাহেব অভিযান চালিয়েছিলেন তাদের কারো কলকাঠি থাকতে পারে কিনা তাও জানি না। শুধু নিশ্চিতভাবে জানি যে বদলীর আদেশটা দিয়েছিল অন্য কেউ না, সরকার। কার কথা শুনে সরকার এটা করেছে তা না জেনে কেন মিডিয়া ট্রায়াল করি আমরা আড়ং-এর বিরুদ্ধে? বড় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বললে আওয়াজটা বেশী লোক শুনবে বলে?
আরেকটা কথা। এক মধ্যবিত্ত পাঞ্জাবী কিনে কয়েকশত টাকা ঠকাতে এতে রাগ হলো আমাদের। কিন্তু যে সরকারের আমলে অনাচারের কারণে কৃষক ধানের মূল্যে ঠকে ফকির হয়, পাটকল শ্রমিকরা পায়না মাসের পর মাস বেতন, যে সরকারের আমলে আমাদের জনগনের লক্ষ কোটি টাকা হয় লোপাট, তার প্রতি এতো রাগ হয়না কেন আমাদের?
সরকারের এক দরবেশ যে ব্যাংক আর শেয়ার মার্কেটের হাজার কোটি টাকা মেরে দিল শুনি, তার টিভি, পত্রিকা আর তার পন্য বর্জনের ডাক আসে না কেন কোথাও?
নিরাপদ আস্ফালনের স্বর্গভূমি হচ্ছে ফেসবুক। এর সবচেয়ে বড় শিকার হয় বাংলাদেশের আইকনরা। ড. ইউনুস, আবেদ, সাকিব- সুযোগ পেলে ধ্বসিয়ে ফেলি কেন আমরা তাদের?
আড়ং হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। ভারত আর পাকিস্তানের পন্যের দাস হওয়া থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করেছে।লাভের টাকায় বহু মানুষের কল্যাণ করেছে।আড়ং-এর বহু পণ্যের মানও বিশ্বমানের।
কোনদিন আড়ং-কে বর্জন করবো না আমি। দোষ হলে তার শাস্তি চা্ইবো, শুধড়ানো চাইবো, কিন্তু আড়ং নামের আড়ালের হাজার হাজার কর্মীর পেটে লাথি মারার আহবান জানাবো না।
এদিকে জাপানে পিএইচডিরত ও গণমাধ্যমকর্মী নাদিম মাহমুদ লিখেছেন,
আড়ংয়ের মত আরেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবেন?
আমরা এক আজব জাতি। এই জাতি বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা যাবে, বিষ মেখে সৌন্দর্য প্রদর্শন করবে, বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে, পঁচা মাংস খেয়ে ঢ়েকুর তুলবে তবুও সেইগুলো বর্জন করবে না আর পোশাকের বর্ধিত দামের বেলায় বর্জন বর্জন বলে ধ্বনি তুলবে।
এটা সেফ নোংরামি ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধরে রাখতে আমাদের দেশে যে প্রতিষ্ঠানটি সত্যি সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে, সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার দাবি তোলার আগে নিজেকে একবার প্রশ্ন করুন তো, আপনি ঐ চিহিৃত ৫২ টি পণ্য এখন পর্যন্ত বর্জন করেছেন কি না? পচাঁ-বাশি খাবার রাখার অপরাধে দফায় দফায় জরিমানা হওয়া সুপারশপগুলোতে কেনা কাটা বন্ধ করেছেন কী না? মেয়াদত্তোর্ণ প্রসাধনী ব্যবহারের অভিযোগ উঠা বিউটিপার্লারটিতে যাওয়া বন্ধ করেছেন কী না? নোংরা পরিবেশে খাবার পরিবেশনের জন্য জরিমানা হওয়া রেস্তোরাটিতে খাওয়া বাদ রেখেছেন কী না? মেয়াদত্তোর্ণ ঔষধ ও চিকিৎসার গড়িমসির অভিযোগ উঠা হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নেয়া বন্ধ করেছেন কী না?
এইসব যদি না করতে পারেন তাহলে, আড়ং বর্জন করার দাবি সেফ আপনার হঠকারিতা ছাড়া কিছু নয়। ভেজাল খাবার খেয়ে শরীরে রোগের অভয়রাণ্য করে ফেলছেন, সেদিকে খেয়াল নেই আর দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে পণ্যের মাধ্যমে তুলে ধরা একটি প্রতিষ্ঠানকে বর্জন হুমকি দেয়া অন্তত আমাদের সাজে না।
বরং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আড়ং কেন এতো জনপ্রিয় হবে? প্রশ্ন করুন, দেশের শত শত কর্পোরেট থাকতে, কেন তারা আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে না? কেন এই দেশে হস্তশিল্প ও কারুকাজের মূল্যায়ন করতে কর্পোরেট হাউজগুলো ব্যর্থ হচ্ছে? কেন আমরা আড়ং বিপরীতে আর একটি আড়ং দাঁড় করাতে পারিনি?
যারা উচ্চ মূল্যের ট্রাগ লাগিয়ে, অধিক মূনাফা আদায় করছে, সেটার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত, তবে এই অজুহাতে প্রতিষ্ঠানটিকে বর্জন করার দাবি মস্তিষ্কের ভ্রমের কারণ বটে।
আর লেজকাটা বাহিনী যে লেজ কাটার অভিপ্রায় করেছিল সেটার জন্য ধিক্কার। এই লেজকাটাদের দৌরাত্মে এই দেশে সৎ পুলিশ, ডাক্তার, প্রকৌশলী, মাজিস্ট্রেট, থেকে শুরু করে করণীকরা ভাল কিছু করতে গিয়েও পারেনি। এরা বদলি, হয়রানীর হুমকি দিয়ে তাদের দল ভারি করে চলছে। আমরা সবাই এই সিস্টেমের যাঁতাকলে জর্জড়িত। আমলাতান্ত্রিক মাস্তানিতে আমাদের কাংক্ষিত অর্জন ভূ-লণ্ঠিত। জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী যেখানে অসহায়ত্ব দেখায় সেখানে গিয়ে ঠেকে প্রধানমন্ত্রী। এই সংস্কৃতি কখনো ভাল কিছু দিতে পারে না। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত.