সেনা সদস্যদের সঙ্গে কী হয়েছিল— জানাল তানভীর
সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তানভীরকে আটক করে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। পরদিন তার বিসিএস পরীক্ষা থাকলে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাবির ওই ছাত্রকে কারাগারে পাঠানো হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিলো। সোমবার (৬ মে) মূখ্য মহানগর হাকিম আদালত তানভীরের মুক্তির আদেশ দেয়।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২ মে) সেনা সদস্যদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার জাসেদুল ইসলাম ঢাবি শিক্ষার্থী তানভীরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। যেসব ধারায় এ মামলা করা হয় সেগুলো হলো-১৮৬/৩৩২/৩৫৩/৪১৯ ও ৩৪। এসব ধারার মধ্যে ১৮৬ নম্বর ধারা হলো- সরকারি কাজে বাধা দেওয়া। ৩৩২ ধারা- সরকারি লোকদের আঘাত করা, ৪১৯ নম্বর ধারা প্রতারণা করা ও ৩৪ নম্বর ধারা হলো এসব করার জন্য পরস্পর যোগসাজশ করা।
সোমবার কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে তর্কের বিষয়ে জানান তানভীর। তিনি এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটি তুলে ধরা হলো— আমি তানভীর আহম্মেদ। গত ২ মে, বৃহস্পতিবার বাইকে করে শাহবাগ থেকে বাংলামোটরে যাওয়ার সময় বাংলামোটর সিগনালে সেনাবাহিনীর একটি জিপ অসতর্কতাবশত ধাক্কা দিলে, আমি ও বাইকের চালক আমার দুলাভাই বাইক থেকে পড়ে যাই।
সেখানে সেনাবাহিনীর জিপ যিনি চালাচ্ছিলেন তাকে শুধুমাত্র জিজ্ঞেস করা হয়, আপনারা যদি অসাবধানে গাড়ি চালান তাহলে অন্যান্যরা কি করবে। তৎক্ষণাৎ জিপের চালক ক্ষমা চাওয়ায় আমরা বাইকে উঠে চলে যাবো, এমন সময় সিগনালে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জন বাইকের চাবি নিয়ে নেয় এবং বাইক সাইড করতে বলে এবং সেনাবাহিনীর জিপটিকেও সাইড করতে বলে।
সেখানে তাকে বলা হয় ঝামেলা মিটে গেছে, চাবি দিয়ে দিন; আমরা চলে যাই। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন ইউনিফর্ম পড়া বাহিনীর সাথে আমরা খারাপ ব্যবহার করেছি এবং আর্মির যারা ছিলেন সেখানে বলেন তাদের উর্ধ্বতন কাউকে জানাতে। পেছনেই একজন বিগ্রেডিয়ার জেনারেলের গাড়ি ছিল, উনি তখন ঘটনাস্থলে আসেন এবং তখন একজন সৈনিক আমার দুলাভাইয়ের কলার চেপে ধরে মারধর করেন।
এতক্ষণে আমি যদিও কোন কথা বলিনি, জিপে থাকা সিভিল ড্রেস পরিহিত একজন আমার পিঠে লাথি দিয়ে ফেলে দেন এবং মারতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশের ভ্যান দিয়ে আমাদের শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়। আগামীকাল পরীক্ষা, ভুল হয়ে গেছে এসব বারবার বলার পরেও তারা কোন কথা শুনতে রাজি ছিলেন না।
তারপর ফোনে কয়েকজন বন্ধুকে অবহিত করার পর তারা থানায় আসে, দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে তারা কথা বলে, প্রক্টর স্যারকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। জানতে পারি, মামলার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক আর্মির যারা আছেন তাদের সাথে কথা বললে হয়তো মামলা না-ও করতে পারেন। শিক্ষকেরা আসলেন, তাদেরকে যেভাবে ঘটনা বলা হলো বিশ্বাস করলেন এবং ঘটনা ক্যাম্পাসের বাইরে হয়েছে বলে কিছু করার নেই বলে চলে গেলেন। আমাদের কাছ থেকে কিছু শোনার প্রয়োজনও মনে করেননি। রাত সাড়ে ১২টায় বন্ধুরা শেষবারের মত দেখা করতে আসে এবং জানায় মামলা হয়ে যাচ্ছে, কিছু করতে পারছে না।
এতো হতাশ লাগছিলো, বলার মত না! কোন অপরাধ না করেও মামলার আসামি হয়ে যাচ্ছি, শাহবাগ থানা থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আমাকে এই মিথ্যা মামলা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারলো না। নিজেকে তুচ্ছ কীটের মত মনে হচ্ছিলো। এতোটা অসহায় অনুভূতি এই ছোট জীবনে আর কখনো হয়নি।
পরদিন কোর্টে তোলার সময় ভ্যানে করে যাচ্ছিলাম যখন এসআই বললো, প্রত্যেকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে পার পেয়ে যান আপনারা। এইবার তো পারলেন না! এতো ছোট লাগছিলো নিজের কাছে নিজেকে! অপরাধ না করেও এরকম কটূক্তি শোনা লাগছে।
তারপর ৫টা দিন হাজতবাস, জীবনে এমন ভয়ংকর সময় আর আসেনি আমার। আর না আসুক। কারো জীবনেই না আসুক। পরীক্ষা না দিতে পারার আক্ষেপ চলে গেলো ১ দিনেই, মনে হলো এখান থেকে বের হতে পারাই বুঝি জীবনের সার্থকতা! প্রত্যেকটা মুহূর্ত অপেক্ষায় থেকেছি এই বুঝি কোন সুসংবাদ আসবে। আসেনি, এক একটা সেকেন্ড কেটেছে বছরের মত হয়ে।
৬ তারিখ কোর্টে তোলা হলো আবার। জামিন আবেদন মঞ্জুর হলো। অপেক্ষা শুরু হলো মুক্তির। অবশেষে ৭ মে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেলাম।
হাজত থেকে বের হয়ে বুঝলাম, এই কয়দিনে ভালোবাসার ঋণে বাধা পড়েছি অনেকের কাছে। এই ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না কোনদিন আমার পক্ষে। ধন্যবাদ দিয়ে, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আপনাদের ঋণ শোধ করা যাবে না জানি; তবুও অসংখ্য ধন্যবাদ ও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই সবার প্রতি যারা আমার জন্য কথা বলেছেন, মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন।
ক্যাম্পাসের সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের সবাই এক হয়ে কথা বলেছেন আমার জন্য, এটি অনেক বড় পাওয়া আমার জন্য। ক্ষুদ্র আমার জন্য আপনারা কথা বলেছেন, রোদে পুড়ে মানববন্ধন করেছেন, একজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ, অনুজ, ভূগোল পরিবার ও সহপাঠীদের কাছ থেকে পাওয়া এই ভালোবাসার ঋণ আমি কোনদিন ভুলবো না।
ক্যাম্পাসে এসেই দেখা করলাম প্রক্টর স্যারের সাথে, কিছুক্ষণ পরে সেখানে আসলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর সহ-সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম ভাই। এই দুইজনকে আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে চাই, আমার জামিনের জন্য তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর জন্য। ধন্যবাদ আমাদের বিভাগের শিক্ষক, সহকারী প্রক্টর মাকসুদুর রহমান স্যারকে।
অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে লেখা। শেষ করি এই বলে, মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। আপনাদের ভালোবাসার প্রয়োজন হবে হয়তো আরো। যেভাবে পাশে ছিলেন এই কয়দিন, আশা করি স্নেহের হাত, ভালোবাসার হাত আমার কাঁধে রাখবেন আগামী দিনগুলিতেও। মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে আমার পাশে চাই। সকলের প্রতি ভালোবাসা। আমার জন্য দোয়া করবেন প্লিজ।