ডাকসু অনিয়ম: প্রার্থী ৫০৯ জন, অভিযোগ করলেন মাত্র ১ জন!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল তাতে একজন প্রার্থী কেউ অভিযোগ জমা দেননি। বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ লিখিত আকারে জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। এতে দেখা গেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’র প্যানেলের জিএস প্রার্থী মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন নির্বাচনে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে তদন্ত কমিটির কাছে দিয়েছেন।
তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ডাকসুতে ২২৯ জনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল সংসদের ১৩টি করে পদের নির্বাচনে মোট ৫০৯জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিপুল সংখ্যক এই প্রার্থীদের অনেকেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও অভিযোগ দিলেন মাত্র একজন। যদিও অন্যান্য প্রার্থীরা বলেছেন, যেখানে গোটা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, আর স্বয়ং প্রশাসন সেখানে জড়িত। তাই তারা তদন্ত কমিটির উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এ কারণেই অভিযোগ দেননি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শুক্রবার সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। রাশেদ খাঁন নামের একজন প্রার্থী ছাড়া বাকী কেউ জমা দেননি। আমরা তাকে আগামী রোববার ডেকেছি। তার অভিযোগ কতটুকু সত্য, তা যাচাই-বাছাই করা হবে। অভিযোগকারী রাশেদের ভোট পুর্নগণনা ব্যাপারে তিনি বলেন, এ দাবিটা অবাস্তব। এটা মেনে নেয়া সম্ভব না।
জানা যায়, ২৮ বছর পর গত ১১ মার্চ ডাকসু ও ১৮টি হল সংসদের নির্বাচন হয়। অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় পাঁচটি প্যানেল। এই নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। পরে ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, ডাকসুতে মোট ২৫টি পদের মধ্যে ২৩টি পদে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ। বর্জনের মধ্যেও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল থেকে নুরুল হক নুর ডাকসুর সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন আর সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়ী হন একই প্যানেলের আখতার হোসেন।
ডাকসু নির্বাচনের পরপরই কয়েকজন শিক্ষার্থী পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশন এবং বিভিন্ন প্যানেল ক্যাম্পাসে অন্দোলন শুরু করলে তা তদন্ত করে কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন প্রদানের জন্য ২১ মার্চ ভিসি সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরবর্তী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক সাজেদা বানুকে আহ্বায়ক করে গঠিত এই কমিটির সদস্যরা হলেন- জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. ইমদাদুল হক, স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ মো. মহিউদ্দিন, অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিক উজ জামান, সিন্ডিকেট সদস্য মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শারমিন রুমি আলীম। এদের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক মো. মাকসুদুর রহমানকে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়।
এদিকে সাত কর্মদিবসের পরে দেখা গেছে, একজন প্রার্থী বাদে বাকী কেউ কোন ধরণের অভিযোগ করেননি। এ ব্যাপারে রাশেদ খাঁন বলেন, আমি নির্বাচনের দিন যা দেখেছি এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে যা এসেছে শুধু সেই বিষয়েই অভিযোগ দিয়েছি। এরমধ্যে-নির্বাচনের দিন বিভিন্ন হলে কৃত্রিম লাইন, শহীদুল্লাহ হলে লুডু খেলা, শিক্ষকদের সহায়তা না করা, কোটা সংস্কার প্রার্থীদের বাঁধাসহ বিভিন্ন প্রার্থীদের উপর হামলা, রোকেয়া ও কুয়েত মৈত্রী হলের জালিয়াতি ও অনিয়ম ইত্যাদিও বিষয়ে ২০ পাতার সংযুক্তি জমা দিয়েছি।
লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, ডাকসু নির্বাচনে সংগঠিত হওয়া জালিয়াতি, কারচুপি ও অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে দেশের সকল খ্যাতনামা গণমাধ্যম। যা ভোটের দিন আমি স্বচক্ষে দেখেছি এবং জালিয়াতি, কারচুপি এবং অনিয়মের প্রমাণগুলো এই আবেদনের সংযুক্তি অংশে ২০টি সংযুক্তি সংযুক্ত করেছি। আমি মনে করি, এসব জালিয়াতি, কারচুপি এবং অনিয়মের ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারেনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আমার দাখিলকৃত প্রমাণসমূহের সাপেক্ষে, আমার পদের সকল ভোট সাংবাদিকদের সামনে পুর্নগণনা করতে হবে। শুধু তাই নয়, এই ডাকসু নির্বাচন ২০১৯-এর পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। অভিযোগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও ছাত্রসমাজের দাবিকে আমলে নিয়ে ডাকসু নির্বাচনের ফলকে বাতিল করে পুন:নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। আগামী রোববার এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ মিটিংয়ে বসবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ছাত্র ফেডারেশনের প্যানেলে জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীর বলেন, তদন্ত কমিটিতে যে অভিযোগ দেয়ার কথা বলেছিল, তাতে আমরা কোন অভিযোগ জমা দেয়নি। সময় স্বল্পতার কারণে এটা দেয়নি বলে তিনি জানান।
ছাত্রদলের প্যানেলের জিএস প্রার্থী মো. আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক বলেন, এই নির্বাচনের ফলাফল পুর্নর্বিবেচনা কিংবা ফলাকেন্দ্রিক এ অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে প্রশাসন- তাই এ তদন্ত কমিটি। কিন্তু আমরাতো নির্বাচনটা কেউ মানছি না। এটাতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, আর সেখানে জড়িত স্বয়ং প্রশাসন। এ জায়গা থেকে আমরা কোন কিছু জমা দেয়নি।
জিএস পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আসিফুর রহমান বলেন, ইতোপূর্বে অসংখ্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছি। কিন্তু তার একটা প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়নি। আমরা তদন্ত কমিটির উপর আস্থা রাখতে পারছি না। এজন্য জমা দেয়নি। তিনি আরও বলেন, ডাকসু নির্বাচনে কি হয়েছে তা পুরো বাংলাদেশের লোক জানে। অনেক শিক্ষকেরাও অনিয়মের বিষয়টি শিকার করেছে। কিন্তু এই অনিয়ম ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে যেহেতু প্রশাসন কিছুই করতে পারেনি, সেহেতু তদন্ত কমিটিও কিছুই করতে পারবে না।