আমাদের স্বপ্ন হত্যা করেছে আখতারুজ্জামান প্রশাসন: রাশেদ খাঁন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক তথা জিএস পদে প্রার্থীতা করেছেন তিনি। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডাকসু ও জীবনের নানা দিক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এই ছাত্র নেতা।
সেখানে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘কিসের স্বপ্ন দেখতাম? আমার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? না। আর কোন শিক্ষার্থী এই স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে না। হয়তো পড়ার জন্য পড়া, সেটি ভেবে ভর্তি পরীক্ষা দিবে, আমার মতো স্বপ্ন নিয়ে আর কেউ পরীক্ষা দেবে না। শিক্ষার্থীদের এই স্বপ্ন হত্যা করেছে ভিসি আখতারুজ্জামান প্রশাসন। ইতিহাস এই প্রশাসনকে ক্ষমা করবে?’ নিচে স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
১। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের স্যারদের অনুরোধে আমি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। অথচ আমি খুব বেশি ভাল ছাত্র ছিলাম না। স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আছে, কিন্তু সেই স্কুলের কোন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে চাইতো না। এযেন শিক্ষকদের জন্য লজ্জার ব্যাপার।
২। শিক্ষকরা তাদের সম্মান বাঁচাতে কিছু শিক্ষার্থীকে কনভিন্স করে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করতো। এখন সেই স্কুলের কি অবস্থা আমি বলতে পারবো না। আমার সেশনে আমরা মাত্র ২ জন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। এরপর ইতিহাস...
৩। পারিনা ইংরেজি, ম্যাথ! আর এদিকে ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, বায়োলজি, হাইয়ার ম্যাথ কোনটা রেখে কোনটা পড়বো?
শিক্ষকরা যেন মাথার উপর পাহাড় সমান বোঝা চাপিয়ে দিলেন।
৪। ইংরেজিতে অতিমাত্রায় দুর্বল ছিলাম। Tense পর্যন্ত পারতাম না। ইংরেজি পড়তে শুরু করলাম স্কুলের এক শিক্ষকের কাছে। তিনি আমাকে Tense শেখানো শুরু করলেন। বললেন, Tense ইংরেজির জননী। Tense ভাল করে শেখো, ইংরেজি পানির মতো সহজ হয়ে যাবে। পরবর্তীতে স্যারের কথায় সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল। আর এদিকে বিজ্ঞানের সাবজেক্টগুলো আরেক জন শিক্ষকের কাছে পড়া শুরু করলাম। প্রথম প্রথম আমি কিছুই পারতাম না, বুঝতাম না। সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো।
৫। সবকিছু বাদ দিয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম। শুরু বলতে চোখ কান বন্ধ করে যতোটা জোরে ক্রিকেট খেলায় নো বল করা যায়, ঠিক ততোটাই জোরে।
৬। মাসখানেক পরে স্কুলের শিক্ষকের কাছে ইংরেজি পড়া বাদ দিয়ে শামিম স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে চলে গেলাম। শামিম স্যার আমাদের শহরে ইংরেজি পড়াতেন। তিনি ইবির ছাত্র ছিলেন৷ তার কাছে গিয়েই মূলত জীবনের অনেককিছু বদলে গেলো।
নবম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত তার পরামর্শ নিয়েই চলেছি।
গ্রামের একটা রোগা-পটকা ছেলের মধ্যে স্যার কি পেয়েছিলেন তা আমি জানিনা! তিনি আমাকে একটু বেশিই ভালবেসে ফেললেন। নবম শ্রেণীর মাঝামাঝি সময়ে স্যার একদিন আমাকে বললেন, তোর মতো ছেলেরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়।
৭। স্যারের সেই কথাটি আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেলো। এই একটি কথা আমার জীবনকে পরিবর্তন করে দিলো। দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকলাম। একটা পর্যায়ে আমি সবকিছু বুঝতে শুরু করলাম। পড়ালেখাটা আমার কাছে সহজ লাগতে থাকলো। আমি পড়তাম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতাম। এই একটি স্বপ্নই আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে সাহায্য করতো।
৮। স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়। আমি স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর গণরুম, গেস্টরুমের নির্যাতন ও জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নেওয়ার কারণে আমার স্বপ্নগুলো ম্লান হতে থাকে। গণরুম, গেস্টরুম সম্পর্কে বিশ্লেষণ করার কিছু নাই। এগুলো সকলেই জানেন। আর ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যে লোকগুলো দেখেন; তার অধিকাংশই গণরুম ও হলের ছেলেরা। হলে থাকার বিনিময়ে ১ম বর্ষ থেকে শুরু করে ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত গোলামি করা লাগে।
৯। আজ আমি এসব কেন লিখছি? এগুলো লেখার কারণ একটাই- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে স্বপ্ন নিয়ে চান্স পাই, তার কতটুকু পূরণ হয়, স্বপ্নটা ধীরে ধীরে কিভাবে ম্লান হয়, তা বোঝাতেই এই লেখা৷
১০। আমার আপনার স্বপ্ন ম্লান হওয়ার পিছনে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যতীত কাউকে দায়ী করবো না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চোঁখের সামনে ও তাদের সহায়তায় দীর্ঘ ২৮ বছর শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়।
১১। তারপরেও এই শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের একটা সম্মান ও ভালবাসা ছিলো। আমরা মেনে নিয়েছিলাম- শিক্ষকরা অসহায়। তারা আমাদের জন্য কিছু করতে চাইলেও ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের ভয়ে কিছু করতে পারেনা৷
১২। ধারণা একদম ভুল। শিক্ষকরা অসহায় না। তারা সবচেয়ে বড় অপরাধী। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থা কোন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেনি। শিক্ষকরা ক্ষমতা ভোগদখল ও ভাগ বন্টন করার জন্যই এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ছাত্র সংসদ থাকলে তারা পছন্দের প্রার্থীকে চাকরি দিতে পারবেনা, পছন্দের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারবেনা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আয়েশি জীবন-যাপন করতে পারবে না, শিক্ষার্থীদের সাথে প্রভুর মতো আচরণ করতে পারবে না। এসব কারণেই তারা ছাত্র সংসদের অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছিলো।
১৩। তারা যে কি পরিমাণ নৈতিকভাবে স্খলিত হয়েছে, তার প্রমাণ তারা ডাকসু নির্বাচনে দেখিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডাকসুর প্রতিনিধি হিসেবে; আসলে তারা যে পাপ ও অন্যায়গুলে করে তা তারা করতে পারবে না। সে কারণে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে জেতাতে তারা যা যা করা দরকার, তার সবকিছু করেছে।
১৪। তারা প্রার্থীদের এজেন্ট রাখেনি, তারা ভোট দেওয়ার পর ভোটারদের হাতে কালি দেয়নি, যেকারণে ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পুনরায় কৃত্রিম লাইন সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা হলে হলে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভোটের রেজাল্ট প্রকাশ করেনি, তারা ভোটের স্থানে/ বুথে সাংবাদিকদের প্রবেশ ও লাইভ নিষিদ্ধ করেছে। সাংবাদিকদের সামনে ভোট গণনা করেনি। তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে ভোটার লাইন তদারকির দায়িত্ব দিয়েছিল। তারা ভোর ৫ টা থেকে হলে হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের লোক দিয়ে দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি করে রাখতে সহায়তা করেছিলো, যাতে করে অনাবাসিক ও অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে না পারে।
১৫। এক কথায়, প্রশাসন ও শিক্ষকরা ভোট ডাকাত ও চোরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলো। এসকল ভোট ডাকাত ও চোর শিক্ষকদের কাছ থেকে আমাদের কিছুই শেখার নেই। তারা নৈতিভাবে পরাজিত ও স্খলিত। কথায় আছে দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। এই শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের কাছে পরিত্যাজ্য। তারা শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এসব শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে?
১৬। আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকে নূন্যতম জ্ঞান লাভ করার আগে বিষপানে মরা উচিত। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে গৌরব, অহংকার ছিলো, তারা ম্লান করে দিয়েছে ২০১৯ সালের প্রশাসন।
কিসের স্বপ্ন দেখতাম?
আমার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? না। আর কোন শিক্ষার্থী এই স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে না। হয়তো পড়ার জন্য পড়া, সেটি ভেবে ভর্তি পরীক্ষা দিবে, আমার মতো স্বপ্ন নিয়ে আর কেউ পরীক্ষা দেবে না। শিক্ষার্থীদের এই স্বপ্ন হত্যা করেছে ভিসি আখতারুজ্জামান প্রশাসন। ইতিহাস এই প্রশাসনকে ক্ষমা করবে?