১২ মার্চ ২০১৯, ০৯:২০

এবারও পূর্ণ আধিপত্য পেল না ক্ষমতাসীনরা

ভিপি নুরুল হক নুর ও গোলাম রাব্বানী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই সংগঠনের প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। গতকালেরটা বাদ দিলে সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০-এ। যেটা সংখ্যায় ছিল সাততম। ওই নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডাকসুর শীর্ষ দুই পদে কখনই ক্ষমতাসনী দলের আধিপত্য ছিল। যে ইতিহাস গতকালও ভাঙলো না; ডাকসুর অষ্টম এই আসরেও বিজয় ছিনিয়ে আনলো স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। নির্বাচনে ক্ষমতাসনীরা জিএস-এজিএস পদ পেলেও খবরদারিত্ব হারিয়েছে প্রধান পদ ভিপিতে। ঘোষিত ফল অনুযায়ী সরকারবিরোধী প্যানেল হিসেবেই পরিচিত বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নেতা নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন।

নির্বাচনে ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন নুর। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট। অন্যদিকে জিএস পদে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ১০ হাজার ৪৮৪ ভোট হয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাশেদ খান পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৩ ভোট। এছাড়াও এজিএস পদে জয়ী হয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন; তার ভোট সংখ্যা ১৫ হাজার ৩০১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ফারুক হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন অডিটরিয়ামে ভিসি ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান এই ফল ঘোষণা করেন।

উচ্চ আদালতের এক রায়ের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল, ছিল সমালোচনাও। তবে নুরের জয়ের মধ্য দিয়ে সামান্যতম হলেও সেই সমালোচনা ঢাকা পড়েছে।

ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিতেও সরকারপন্থী প্যানেল জয়লাভ করতে পারেনি। আজকের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর ভিপি জিএস ঠিকই হয়েছিলেন। কিন্তু তখন তারা ছিলেন সরকারবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নে। তবে এটা সত্য, ডাকসুতে স্বাধীনতার পর মোট ৭ বার এবং এর যারা নের্তৃত্বে এসেছেন; তারা সকলেই বাংলাদেশের রাজনীতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

স্বাধীনতার পর যারা ডাকসুতে এসেছেন তাদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণত সরকার-সমর্থকরা ভোটের মাধ্যমে জেতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসুর ইতিহাসে এমন নজির নেই। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনের পর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের কোনো নেতা ডাকসু নির্বাচনে জয় পায়নি।

তথ্যমতে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ডাকসু নির্বাচন ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। অন্যদিকে জিএস হন একই সংগঠনের মাহবুবুর জামান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে ডাকসুর দুটি পদের দায়িত্ব পালন করেন সংগঠনটির এই দুই নেতা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল।

১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম দুই নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মদদপুষ্ট কোনো নেতা ওই সময় জয় পাননি।

১৯৮২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮৯ পর্যন্ত ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও ১৯৮৯-৯০ সেশনে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি’র দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ পান মুশতাক আহমেদ। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন; যদিও সে সময় তাদের মূল দল বিএনপি ক্ষমতাসীন ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবেই ডাকসুতে ক্ষমতাসীনদের খবরদারিত্ব খর্ব হয়েছে।

পেছন ফিরে দেখা
১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম, ১৯৫৩-৫৪ সালে এস এ বারী এটি ও জুলমত আলী খান, ফরিদ আহমেদ। এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

কেন জরুরি ছিল ডাকসু নির্বাচন
বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী সিনেটের ১০৪ সদস্যের মধ্যে ৫ জন থাকে ছাত্র প্রতিনিধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে ছাত্র স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করেন এই ছাত্র প্রতিনিধিরাই। ডাকসু নির্বাচন নেই বলে এই নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিও ছিল না। ফলে ছাত্রদের অনেক দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অজানাই থেকে যাচ্ছিল, আবার অনেক দাবি বাস্তবায়ন গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার পাচ্ছিল না।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে আমাদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ক্যাম্পাসের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। কিন্তু নির্বাচিত ও সর্বজনীন ছাত্রনেতৃত্ব না থাকায় সেগুলো ঠিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছিলো না। গড়ে উঠছিল না সঠিক নেতৃত্ব। তবে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই বন্ধ্যাত্ব ঘুচবে বলে তারা মনে করছেন।