০৫ মার্চ ২০১৯, ১৭:১২

ডাকসু নির্বাচনের জয় পরাজয়ে তিন ফ্যাক্টর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ

প্রায় ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দীক্ষার সবচেয়ে বড় বাতিঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে যেমন বিপুল আগ্রহ অন্যদিকে তীব্র আশঙ্কা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে সম্মানজনক এ পাওয়ার হাউজের নেতৃত্বের চাবি কার বা কোন দলের হাতে যায় তা দেখার অপেক্ষায় সব মহল। আর ছাত্র সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের নেতা ও সংগঠকরা নির্বাচনের ফল নিজেদের পক্ষে আনার জোর লড়াইয়ে নেমেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নির্বাচনে জয় পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে জাতীয় রাজনীতি, ক্যাম্পাস পরিস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পক্ষগুলোর সাংগঠনিক দক্ষতা ও সক্ষমতা।

ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সাবেক ও বর্তমান নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগের ডাকসু নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডাকসু নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি ও ক্যাম্পাসের সমস্যা-সংকট এবং শিক্ষার্থীদের মনন-মানসিকতা বড় ভূমিকা পালন করে। এই দুই প্রভাবকের পাশাপাশি ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিগত ইমেজ, প্রচারণা কৌশল এবং দল ও ব্যক্তির সাংগঠনিক সক্ষমতা জয় পরাজয় নির্ধারণ করে।

তারা বলছেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশেও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ডাকসুতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব ছিল বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরও ছিল বড় অংশীদারিত্ব। আর ১৯৯০ সালের ৬ জুন অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। তবে এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর শক্তি, সামর্থ্য ও জনপ্রিয়তা অনেকটাই ম্রিয়মান। সংখ্যায়ও কম। ছাত্রদল দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক নেতৃত্বের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথেও তাদের সংযোগ ও বোঝাপড়া কম। বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও ছাত্রদলের রাজনীতিতে যোগ দেয়ার হার বেশি নয়। ফলে ছাত্রী হলগুলোতে প্যানেলই গঠন করতে পারেনি সংগঠনটি।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্যাম্পাসে প্রচণ্ড প্রতাপ নিয়ে চলেছে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় দুই বছর ছাত্রদল-ছাত্রলীগ তখনকার সরকারের বিরুদ্ধে একসাথে আন্দোলনও করেছে। এই এক যুগের বেশি সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চারটি কমিটি দায়িত্ব পালন করেছে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি হল কমিটির পাশাপাশি অনুষদ এবং বিভাগভিত্তিক কমিটিও গঠন করে। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসজুড়ে ছাত্রলীগের পক্ষে এবং ছাত্রলীগের হয়ে কাজ করার বিপুল কর্মী-শক্তি রয়েছে। ছাত্রলীগই একমাত্র ডাকসুর ২৫টি পদে এবং সব হলে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষনা করেছে। এর মধ্যে হলগুলোতে অন্তত ৩৬টি পদে ছাত্রলীগ প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে চলছেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের বিপরীতে শক্তি ও সামর্থ্যে সমান এমন ছাত্র সংগঠন প্রকাশ্য নেই। তবে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার পরিষদ নামের এ মঞ্চ ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দাবি বাস্তবায়নে মাঠে নেমে একদিকে যেমনি জনপ্রিয়তা পেয়েছে অন্যদিকে সাংগঠনিক শক্তিও কিছুটা তৈরি হয়েছে। ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভোটারদের অনেকের মধ্যে তাদের পক্ষে সমর্থ রয়েছে বলে দাবি করছেন সংগঠকরা। তবে এ মঞ্চে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শিক্ষার্থীদের সমাগম থাকায় তাদের ঐক্য কতটা স্থায়ী হয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

এবারের নির্বাচনে ইসলামী সংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন প্যানেল ঘোষনা করলেও ক্যাম্পাসে শক্তিশালী অবস্থান দেখা যায়নি। তবে তাবলীগ জামাতের সাথে যুক্ত অনেকে এ প্যানেলের পক্ষে কাজ করতে পারেন বলে জানা গেছে। আর ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে না থাকলেও ছাত্র শিবিরও বিভিন্ন প্যানেলে কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকের পক্ষে গোপনে কাজ করছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। নিষিদ্ধ থাকা হিজবুত তাহরিরও একই পথ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রলীগের অবস্থান শক্ত হলেও গত ১০ বছরে তাদের হাতে অনেক ছাত্র লাঞ্ছিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের জেরে প্রাণও হারিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনে দৃষ্টিহীন এবং ক্যাম্পাসহারাও হয়েছেন অনেক শিক্ষার্থী। মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত বলেও নাম এসেছে এ সংগঠনটির একাধিক নেতাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি প্রতিপক্ষ প্যানেলের বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উপরও বল প্রয়োগ এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। গেস্টরুম এবং গণরুম রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতাপ ও ক্ষমতার অপচর্চায়ও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ। সেই ক্ষোভ এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় ছাত্রদল, বাম এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ভোট দেবেন অনেকে। এক্ষেত্রে যার বা যাদের গণসংযোগ যত বেশি হবে; তিনি বা তারা তত বেশি ভোট পাবেন। আবার ছাত্রলীগের বর্তমান নেতাদের অনেকেরও অপেক্ষাকৃত ক্লিন ইমেজ রয়েছে। তারা সেই ইমেজ ও সাংগঠনিক সক্ষমতায় জয় পেতে পারেন। পাশাপাশি এর আগে কখনও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ডাকসুতে জয় পায়নি- সে রেকর্ডও চোখ রাঙাচ্ছে ছাত্রলীগকে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক ছাত্রনেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ব্যক্তিগত ইমেজ বা কারিশমায় এ নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে আনা কঠিন। কেননা এ জন্য কেউ পর্যাপ্ত সময় পায়নি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারো যদি সেই সাংগঠনিক ও বিশ্লেষনী ক্ষমতা থাকে এবং পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পান; তবে তিনি বা তারা জয় পেতে পারেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে কোন একটি পক্ষ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ভিপি পদে ছাত্রলীগ কিংবা কোটা সংস্কারকারীদের প্রার্থীদের একজন, জিএস পদে ছাত্রলীগ অথবা ছাত্রদল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একজন এবং এজিএস পদে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের প্রার্থীদের মধ্যে একজন নির্বাচিত হতে পারেন।