ট্রাকচাপায় হত্যা করে লাশ দুটিও নিয়ে গিয়েছিল স্বৈরশাসক বাহিনী
আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেলিম-দেলোয়ার দিবস। ১৯৮৪ সালের এই দিনে গণআন্দোলন চলাকালে স্বৈরশাসকের পুলিশের ট্রাক সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের ওপর তুলে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন সেলিম ও দেলোয়ার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র। হত্যার পর লাশ দুটিকে নিজেরাই তুলে নিয়ে পোস্টমার্টেমে করে পুলিশ। দাফনও করা হয় তাদের পাহারায়।
ইতিহাসের তথ্য, দেশে তখন সামরিক শাসন ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকালে ছিল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিলের কর্মসূচি। প্রথা অনুযায়ী প্রতিটি হল থেকে সব ছাত্র সংগঠনের পৃথক পৃথক মিছিল বিকাল ৪টার মধ্যে মধুর ক্যান্টিন ও সংলগ্ন অঞ্চলে সমবেত হয়। কেন্দ্রীয় নেতারা মধুর ক্যান্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন, সমাবেশকে উজ্জীবিত করেন। যদিও সেদিন ঘটতে যাচ্ছে, সবকিছুই ছাত্র সমাজের কাছে অজানা ছিল।
তারপরও মিছিলটি শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে রোকেয়া হল পেরিয়ে টিএসসি হয়ে, কার্জন হলের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দাঙ্গাপুলিশ মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয়।
সেদিন সেলিম ও দেলোয়ার ছিলেন মিছিলের পেছন দিকে। মিছিলটি ফুলবাড়িয়া এলাকায় পৌঁছানোর পরই বর্তমান ফায়ার ব্রিগেড অফিসের পাশ থেকে পুলিশের সেই ট্রাক অতর্কিতে পেছন থেকে মিছিলের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে চালিয়ে দেয়া হয়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন সেলিম ও দেলোয়ার। সেলিম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। আর দেলোয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
তাদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখে। সেই ঘটনার পর থেকে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমাবেশে আর রাজপথের এরশাদবিরোধী মিছিলে ছাত্ররা স্লোগান দিতে থাকে; ‘সেলিম, দেলোয়ার, তিতাস; আন্দোলনের লাল পলাশ’।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা শফী আহমেদ লিখেছেন, ‘সে এক নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ব্যবহার করল, নির্বিচার লাঠিচার্জ করল, কে নেতা কে কর্মী সেই লাঠিচার্জে কোনো বাচবিচার ছিল না। ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ারের লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। তার পরের ইতিহাস আরও নিষ্ঠুর-নির্মম! সেই লাশগুলো তাদের গ্রামের বাড়ি পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং দাফন করা হলো। আজ সেলিম-দেলোয়ারের শহীদ হওয়ার দিনে তাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’
দিবসটি পালনে বিভিন্ন দল ও সংগঠন আজ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের সামনে শহীদ সেলিম স্মৃতিফলক এবং জহুরুল হক হলের সামনে শহীদ দেলোয়ার স্মৃতিফলকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও আলোচনা সভা।
এছাড়া শহীদ সেলিম পরিষদ ও পাঠাগার পটুয়াখালীর বাউফলে শহীদ সেলিমের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, পবিত্র কোরআনখানি, স্মরণসভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।