সর্বশেষ ৭ নির্বাচনের একটিতেও জয় পায়নি সরকারপন্থীরা
চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তোড়জোড়। উচ্চ আদালতের এক রায়ের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ ২৮ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। নির্ধারণ করেছে নির্বাচনের তারিখও। ঘোষিত তারিখ অনুযায়ী আগামী ১১মার্চ এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যা নিয়ে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণেও আশার আলো জেগেছে।
যদিও নির্বাচনকে ঘিরে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি উদ্বেগও রয়েছে যথেষ্ট। সাধারণ ছাত্ররা মনে করছেন, সুষ্ঠু নিবার্চন হলে কোনো পক্ষেরই সহজ জয় পাওয়া সম্ভব হবে না। তাই নির্বাচন নিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিরতার শঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, সুষ্ঠু নিবার্চনের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে তা সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামানের সাফ বক্তব্য, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অনাস্থার কারণ নেই। শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা-কর্মচারী এসোসিয়েশনসহ অনেক সংগঠনের নির্বাচন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়, সুষ্ঠুও হয়। ডাকসু নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অবাধ হবে।
ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যতগুলো ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিতেও সরকারপন্থী প্যানেল জয়লাভ করতে পারেনি। আজকের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং মতিয়া চৌধুরী ডাকসুর ভিপি জিএস ঠিকই হয়েছিলেন। কিন্তু তখন তারা ছিলেন সরকারবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নে। তবে এটা সত্য, ডাকসুতে স্বাধীনতার পর মোট ৭ বার এবং এর যারা নের্তৃত্বে এসেছেন; তারা সকলেই বাংলাদেশের রাজনীতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন।
স্বাধীনতার পর যারা ডাকসুতে এসেছেন তাদের পরিচয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণত সরকার-সমর্থকরা ভোটের মাধ্যমে জেতেন না। স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসুর ইতিহাসে এমন নজির নেই। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনের পর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের কোনো নেতা ডাকসু নির্বাচনে জয় পায়নি।
তথ্যমতে, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ডাকসু নির্বাচন ১৯৭২ সালে। সদ্য স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। অন্যদিকে জিএস হন একই সংগঠনের মাহবুবুর জামান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে ডাকসুর দুটি পদের দায়িত্ব পালন করেন সংগঠনটির এই দুই নেতা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল।
১৯৭৯, ১৯৮০ ও ১৯৮২ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। প্রথম দুই নির্বাচনে যথাক্রমে জাসদ-ছাত্রলীগের এবং বাসদ-ছাত্রলীগের প্রার্থী হয়ে সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জিতেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মদদপুষ্ট কোনো নেতা ওই সময় জয় পাননি।
১৯৮২ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮৯ পর্যন্ত ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন আখতারুজ্জামান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও ১৯৮৯-৯০ সেশনে ছাত্রলীগ থেকে ভিপি’র দায়িত্ব পালন করেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদ পান মুশতাক আহমেদ। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন; যদিও সে সময় তাদের মূল দল বিএনপি ক্ষমতাসীন ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এভাবেই ডাকসুতে ক্ষমতাসীনদের খবরদারিত্ব খর্ব হয়েছে।
পেছন ফিরে দেখা
১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। ১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম, ১৯৫৩-৫৪ সালে এস এ বারী এটি ও জুলমত আলী খান, ফরিদ আহমেদ। এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।
কেন জরুরি ডাকসু নির্বাচন
বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী সিনেটের ১০৪ সদস্যের মধ্যে ৫ জন থাকবে ছাত্র প্রতিনিধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে ছাত্র স্বার্থ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করতেন এই ছাত্র প্রতিনিধিরাই। ডাকসু নির্বাচন নেই বলে এই নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিও নেই। ফলে ছাত্রদের অনেক দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অজানাই থেকে যাচ্ছে, আবার অনেক দাবি বাস্তবায়ন গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের অনেক দাবি দীর্ঘদিন ধরে অবাস্তবায়িত। তারা ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করলেও তাদের দাবির ব্যাপারে ছাত্র সংগঠনগুলো সরব নয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাসে আমাদের নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ক্যাম্পাসের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। কিন্তু নির্বাচিত ও সর্বজনীন ছাত্রনেতৃত্ব না থাকায় সেগুলো ঠিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সঠিক নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। তাই যত দ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে সবার জন্য ততটাই মঙ্গল। আগামীকাল ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে মূলত ডাকসু নির্বাচনের সেই উদ্যোগই আইনগতভাবে স্বীকৃতি পাবে। যা বাস্তবায়ন হবে ১১মার্চ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।