স্বাধীনতার পর থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে যত লাশ
৯ জানুয়ারি। ১৯৯২ সালের এইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদল। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও এদিনে সাবেক এ নেতাকে স্মরণ করে ছাত্রলীগ। বাদলের ২৭তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার সকালে শামসুন্নাহার হল সংলগ্ন শহীদ মনিরুজ্জামান বাদল চত্ত্বরে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে ছাত্রলীগ।
শুধু সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান বাদল নয়, এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সাক্ষী বহু সহিংস সংঘাত ও হামলার ঘটনার। স্বাধীনতার পর থেকে এই সংঘাত ও হামলার ঘটনা বেড়েছে অনেকগুণ। এসব সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৬০ জন শিক্ষার্থী|
ক্যাম্পাসে সংগঠিত এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ শাস্তি পায়নি। একমাত্র ১৯৭৪ সালে সংগঠিত চাঞ্চল্যকর ৭ খুনের পর একটি মাত্র মামলার বিচার এবং রায় পাওয়া গেছে। কিন্তু পরে খুনিদের সেই শাস্তিও বাতিল হয়ে গেছে।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করে। আইন অনুযায়ী মামলাও দায়ের করা হয়। কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো বিচারের মুখ দেখে না।
ক্যাম্পাসে এ পর্যন্ত ঠিক কতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সে সম্পর্কে কোনও নথি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। ফলে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৪ থেকে সর্বশেষ ২০১০ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোট ৬৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত চার জন আছেন বহিরাগত।
বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল, ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার শিক্ষার্থীর নাম আবু বকর সিদ্দিক। ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্যার এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের সময় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এ মেধাবী ছাত্র মারা যান। একইভাবে ২০০৪ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সৃষ্ট সংঘর্ষে মারাত্মক আহত হন ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল ইসলাম খোকন। ওই ঘটনার তিনদিন পর তিনি মারা যান।
ভিন্ন ঘটনায় ১৯৯৯ সালে খুন হন মনির হোসাইন ও ফিরোজ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র। ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল ক্যাম্পাসে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা পার্থ প্রতিম আচার্য। একই বছর দলীয় কোন্দলের জেরে খুন হন ছাত্রলীগের জগন্নাথ হল শাখার এক ছাত্র। যদিও তার নাম পাওয়া যায়নি।
১৯৯৭ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্র আরিফ। এছাড়া কার্জন হল থেকে সেসময় উদ্ধার করা হয় শাহিন নামে আরেক ছাত্রের মৃতদেহ।
১৯৯৬ সালে ছাত্রলীগের অর্ন্তকোন্দলের জেরে সংঘর্ষে প্রাণ হারান জগন্নথ হলের এক সাধারণ ছাত্র। ১৯৯৪ সালে ফজলুল হক হল থেকে উদ্ধার করা হয় গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মৃতদেহ।
১৯৯৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলীয় অর্ন্তকোন্দলে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায় ছাত্রলীগ কর্মী বুলবুল। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্র দলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে খুন হন সরোয়ার হোসেন মিঠু নামেআরেক শিক্ষার্থী। এছাড়া ২৭ অক্টোবর জগন্নাথ হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আরেক ছাত্র।
১৯৯৩ সালে এক সংঘর্ষে প্রাণ হারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কর্মচারীসহ জিন্নাহ নামের এক শিক্ষার্থী। একই বছর ২২ নভেম্বর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র অলক কান্তি পাল।
১৯৯২ সালের ৯ জানুয়ারি শামসুন্নাহার হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তৎকালীন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদল। একই বছর ১১ জুলাই কার্জন হলের সামনে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী তন্ময়।
১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ক্যাম্পাসে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের কর্মীদের গুলিতে খুন হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসেন রাজু। একই বছর ৪ সেপ্টেম্বর দলীয় অর্ন্তদ্বন্দ্বে খুন হন দুই ছাত্রদল নেতা আশরাফুল আজম মামুন এবং খন্দকার মাহমুদ হোসেন।
১৯৯১ সালের ২০ জুন ক্যাম্পাসের ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে খুন হন মাহবুবুর রহমান নামে এক ছাত্র। একই বছর ২৭ অক্টোবর ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিন বহিরাগত ছাত্র গালিব, লিটন ও মিজান।
১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা চুন্নুর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে খুন হন সূর্যসেন হলের ছাত্র আলমগীর কবীর। এছাড়া একই বছর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন হাজী মুহম্মদ মহসীন হলের এক ছাত্রলীগ (জাসদ) কর্মী। সেইদিনই ফজলুল হক হলের ডরমেটরি থেকে উদ্ধার করা হয় শাহীন নামে আরেক ছাত্রের লাশ।
১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ছাত্রদল ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে নিহত হন ডা. মিলন। ১৯৮৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদলের সঙ্গে গোলাগুলিতে মধুর ক্যান্টিনের সামনে নিহত হন ছাত্রলীগ (জাসদ) কর্মী কফিল উদ্দিন। একই বছর ২৯ ডিসেম্বর ফিন্যান্স বিভাগের আরিফ নামের এক ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর খুন হন বজলুর রশিদ নামে এক ছাত্র। ১৯৮৭ সালের মার্চে মোহসিন হলের ৪২৬ নম্বর রুমে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফারণে নিহত হন ছাত্রদল নেতা বাবু, মহিউদ্দিন ও নুর মোহাম্মদ। ঠিক তার পরেরদিনই ছাত্রলীগ (জাসদ) এর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন ছাত্রদল কর্মী হালিম।
১৯৮৬ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় আসলাম নামের এক ছাত্র। ১৯৮৫ সালে মুহসীন হলের সামনে ছাত্রদল ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাউফুন বাসুনিয়া। ১৯৮৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে নিহত হয় সাধারণ ছাত্র জয়নাল। ১৯৭৮ সালে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী লিয়াকতসহ আরও দুই ছাত্র।
ছাত্রদলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক বলে পরিচিত মাহবুবুল হক বাবলু। ১৯৮৬ সালের শেষের দিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়ে ১৯৮৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিলেন। এরশাদ সরকারের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে বোমা হামলায় নিহত হন তিনি।
১৯৭৭ সালে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় সংগঠনটির শীর্ষ নেতা লুকুসহ আর দুই কর্মী। একই বছর তখন ক্যাম্পাসে সক্রিয় নুর গ্রুপের ক্যাডারদের হাতে প্রাণ হারায় আরেক ছাত্রলীগ নেতা আওরঙ্গ এর ভাই রন্টু। এছাড়া ওই বছরই খুন হন হনু ও গোপাল নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বহুল আলোচিত ৭ ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলে। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার বছর পরে আদালত শফিউল আলম প্রধানকে দণ্ডাদেশ দেন। যিনি পরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি আসামিদের দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর আসামিরা সবাই ছাড়া পেয়ে যায়।
২০০০ সালের ১ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জ বিহারী নাগ। মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত ইয়াসমিন ও ইসমাইল নামে দুই ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায় ২০০৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোহসিন হলের বাসুনিয়া গেটের সামনে
২০০৪ সালের ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয় এলিফেন্ট রোডের চিহ্নিত সন্ত্রাসী শামসুর লাশ।